যশোরে বিতর্কিত জনপ্রতিনিধি ও সন্ত্রাসীরা আত্মগোপনে
পুলিশের অভিযান

যশোরে পুলিশের অভিযান। ছবি: সমকাল
যশোর অফিস
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০১:৫৯
যশোরে হঠাৎ করেই অবনতি ঘটে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। বেড়েছে খুন, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার ও কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা। তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে কয়েক দিন ধরে চলা পুলিশের অভিযানে ফিরেছে কিছুটা স্বস্তি।
বুধবার জেলা শহরের মোড়ে মোড়ে পুলিশের তল্লাশি জোরদার করা হয়। এ অভিযানে পৌর কাউন্সিলরসহ অন্তত ৬৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে অস্ত্র ও মাদক। এদিকে শীর্ষস্থানীয় অনেক সন্ত্রাসী ও বিতর্কিত জনপ্রতিনিধি আত্মগোপন করেছেন। তবে এ অভিযান নিয়ে এমপি কাজী নাবিল আহমেদের অনুসারীরা প্রশ্ন তুলেছেন। অন্যদিকে, সাধারণ মানুষ ছাড়াও একে স্বাগত জানিয়েছেন সরকারি দলের একাংশের নেতাকর্মীরা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হিসাব অনুযায়ী, জেলায় গত দেড় মাসে খুন হয়েছেন ১২ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ছয়জন ও ফেব্রুয়ারির প্রথম ১৫ দিনে ছয়জন খুন হন। একই সঙ্গে বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতায় চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও মাদক কারবার। সরকারদলীয় এক জনপ্রতিনিধির প্রশ্রয়ে থাকা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে উঠেছে এসব অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ।
১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে যশোর পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও জেলা যুবলীগের প্রচার সম্পাদক জাহিদ হোসেন মিলনকে তিন সহযোগীসহ মদ্যপান অবস্থায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একই দিন দুপুরে সন্ত্রাসী ও বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা মেহবুব রহমান ম্যানসেলের নেতৃত্বে যশোর সরকারি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে দ্বিতীয় দফায় হানা দেয় সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় মামলা হলে ম্যানসেলসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর আগে গত বছরের ৫ মার্চ একই অফিসে হামলা, সরকারি কাজে বাধা দেওয়া ও কর্মচারীকে মারধরের ঘটনায় আটক হওয়া ছাড়াও যুবলীগের শহর কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক পদ থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন তিনি।
এদিকে কাউন্সিলর মিলনকে গ্রেপ্তারের পরদিন বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের প্রত্যাহার দাবি করে কর্মবিরতিসহ লাগাতার কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন যশোর-৩ (সদর) আসনের সরকারদলীয় এমপি কাজী নাবিলের সমর্থক সদর উপজেলা ও পৌরসভার জনপ্রতিনিধিরা। পুলিশের হাতে আটক কাউন্সিলর মিলন, শীর্ষ সন্ত্রাসী ম্যানসেলসহ বেশির ভাগই নাবিলের অনুসারী।
পুলিশ জানায়, ম্যানসেল ও মিলনের বিরুদ্ধে যশোর কোতোয়ালি থানায় হত্যা, চাঁদাবাজি ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একাধিক মামলা রয়েছে। এমনকি সাংসদ নাবিলের বাড়িতে হামলা মামলারও আসামি মিলন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শহরের একাধিক বাসিন্দা জানান, পাড়ায় পাড়ায় কিশোর গ্যাং বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজি, মাদক, খুন ও জখমের ঘটনা ঘটছে। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। পুলিশ এদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করায় তারা খুশি। এদের গডফাদারদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে পারলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
এদিকে বিতর্কিত অনেক জনপ্রতিনিধি কয়েক দিন ধরে ব্যক্তিগত কার্যালয়েও বসছেন না। তবে সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিপুল দাবি করেছেন, নাবিল আহমেদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত জনপ্রতিনিধিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিচ্ছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ার্দ্দার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলাল হোসাইনের অপসারণের দাবি জানানোর পর পুলিশের একাধিক টিম তাঁর বাড়ির সামনে অবস্থান নিয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বাড়িতে গিয়ে পুলিশ হুমকি দিচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার যশোর পৌরসভার সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের বিরুদ্ধে কর্মসূচি ঘোষণাকালে লিখিত বক্তব্য পাঠকারী প্যানেল মেয়র মোকসিমুল বারী অপু পরে গণমাধ্যমকে বলেন, সংবাদ সম্মেলনের এক পর্যায়ে এক জনপ্রতিনিধি তাঁর হাতে একটি কাগজ দিয়েছিলেন। সেই লেখা তিনি পাঠ করেছেন। সেখানে কী লেখা ছিল, আগে থেকে জানতেন না তিনি। এ ছাড়াও লিখিত বক্তব্যে যেসব জনপ্রতিনিধির বাড়িতে পুলিশ হানা দিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে, তাদের মধ্যে কাউন্সিলর রাজীবুল আলম ও সাইদুর রহমান রিপন ওই দাবি অসত্য বর্ণনা করে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন।
এমপির অনুসারী হলেও কাউন্সিলর মিলনকে আটকের ঘটনায় কর্মসূচি ঘোষণাকালে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হায়দার গণি খান পলাশ এবং সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সভাপতি মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী। হায়দার গনি বলেন, পৌরসভার সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পৌর পরিষদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। পৌরসভার কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, পুলিশের এ অভিযানে জনসাধারণের মাঝে স্বস্তি ফিরেছে। অভিযানকে বিতর্কিত করতে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠকারী কাউন্সিলর আওয়ামী লীগের কেউ না। তিনি বিএনপি থেকে এসেছেন। এখনও সেই দলের রাজনীতি চর্চার অভ্যাস থেকে গেছে।
যশোর সদর উপজেলা ও পৌরসভার জনপ্রতিনিধিরা দুই অংশে বিভক্ত। একাংশের নেতৃত্বে এমপি নাবিল আহমেদ, অপর অংশ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের অনুসারী। জেলা সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন চলেন পৃথর ধারায়।
এদিকে পুলিশের বিরুদ্ধে জনপ্রতিনিধিদের একাংশের করা অভিযোগ সম্পর্কে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) বেলাল হোসাইন বলেন, ‘পুলিশের অভিযান কোনো ব্যক্তি কিংবা জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে নয়। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক ও কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত ও মদদদাতাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। পুলিশের বিরুদ্ধে হুমকি কিংবা হয়রানির অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। শুদ্ধি অভিযানকে বিতর্কিত করতে তৎপরতা চলছে।’