টানেলে কেন এত দুর্ঘটনা

বেপরোয়া গতির কারণে বঙ্গবন্ধু টানেলে ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা। ছবি: সমকাল
তৌফিকুল ইসলাম বাবর
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ১৮:৪০
অতিরিক্ত গতি, অদক্ষ চালক এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ির কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। ঘটছে হতাহতের ঘটনাও। এ ছাড়া গাড়ি চালানোর সময় টানেলের অভ্যন্তরে সৌন্দর্য উপভোগ এবং গাড়ির গতি বাড়িয়ে-কমিয়ে সেলফি তোলার সময়ও অসাবধানতাবশত দুর্ঘটনা ঘটছে। গত বছরের ২৮ অক্টোবর উদ্বোধনের পর থেকে এ পর্যন্ত ছোট-বড় সাতটি দুর্ঘটনা ঘটেছে টানেলে। এসব ঘটনায় দু’জনের প্রাণহানির পাশাপাশি ১৯ জন আহত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হয় টানেলের স্থাপনার বিভিন্ন অংশ।
সর্বশেষ গত ১১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় টানেলের ভেতরে একে একে চারটি গাড়ির সংঘর্ষ হয়। এতে টানেলের ডেকোরেশন বোর্ড ভেঙে যায় ও অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্ঘটনায় আহত হন পাঁচজন। টানেল কর্তৃপক্ষ জানায়, একটি মাইক্রোবাস পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা প্রান্তের দিকে যাচ্ছিল। এ সময় পেছন থেকে একটি প্রাইভেটকার ওই মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আরও দুটি গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে টানেলের ভেতরের টিউবের পাশে আঘাত হানে। এতে টিউবের ডেকোরেশন বোর্ড ভেঙে যায় এবং অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টানেলের দায়িত্বে থাকা নৌবাহিনীর সদস্যরা গাড়িগুলো আটক করে রাখে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল কর্তৃপক্ষের সহকারী প্রকৌশলী তানভীর রিফা বলেন, ‘টানেলে যাতে দুর্ঘটনা এড়ানো যায় সেজ ন্য গাড়ির গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনেক সময় অনেক বেপরোয়া চালক অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর চেষ্টা করেন। এতে দুর্ঘটনা ঘটে যায়। এ ছাড়া চালকের অদক্ষতা ও গাড়ির ফিটনেসের বিষয়টি তো রয়েছেই।’
টানেল উদ্বোধনের এক দিন পর ৩০ অক্টোবর টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে টোল প্লাজায় একটি প্রাডো গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রেলিংয়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে প্রথম দুর্ঘটনায় পড়ে। এর দু’দিন পর ৩ নভেম্বর টানেলের ভেতরে একটি প্রাইভেটকারকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয় বেপরোয়া গতির বাস। এই ঘটনায় কারের ৪ যাত্রী আহত হন। কারটি দুমড়েমুচড়ে যায়।
গত ১৬ জানুয়ারি সকালে টানেল সড়কের বৈরাগ এলাকায় দ্রুতগতির মাইক্রোবাসের ধাক্কায় টানেলের সিকিউরিটি পোস্ট ভেঙে দায়িত্বরত একজন নৌবাহিনীর সদস্যসহ সাতজন আহত হন। এর আগে ১৮ জানুয়ারি সকালে টানেলের ভেতর চাকা ফেটে পিকআপ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা দেয় টানেলের টিউবে। গত ৩০ জানুয়ারি ভোরে টানেলের সংযোগ সড়কের আনোয়ারা প্রান্তে ট্রাকের ধাক্কায় এক সাইকেল আরোহী নিহত হন। গত বছরের ১০ নভেম্বর টানেলের টোলবুথের মুখে যাত্রীবাহী বাস উল্টে একজন নিহত ও অন্তত ১২ জন আহত হন।
তখন পতেঙ্গা থানার ওসি কবিরুল ইসলাম জানান, বাসটি পতেঙ্গা থেকে যাত্রীদের নিয়ে টানেল পরিদর্শনের জন্য যাচ্ছিল। বাসে প্রায় ৫০ জন যাত্রী ছিলেন। চালকের অদক্ষতার কারণে গাড়ি হয়তো উল্টে গেছে বলে মনে করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
টানেলের সর্বোচ্চ গতিসীমা হচ্ছে ৬০ কিলোমিটার। কিন্তু অনেক চালক নিয়ম ভঙ্গ করে গতির নেশায় বেপরোয়া গাড়ি চালায়। এতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে যায়। দুর্ঘটনা রোধে টানেলের ভেতরে-বাইরে স্পিড ক্যামেরা বসানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে বঙ্গবন্ধু টানেল কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া টানেলে সেলফি তোলা, গতি কমানো-বাড়ানো, ইচ্ছেমতো গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এটা টানেল কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।
তথ্যমতে, উদ্বোধনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলে এক মাসে গাড়ি চলাচল করেছে এক লাখ ৭৪ হাজার ৮৭১টি। সে হিসেবে প্রতিদিন গড়ে গাড়ি চলেছে ৫ হাজার ৮২৯টি। সমীক্ষা অনুযায়ী এর চেয়েও বেশি গাড়ি চলাচলের কথা। কিন্তু গাড়ির চাপ কম থাকার পরও দুর্ঘটনা ঘটছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবার সপ্তাহের অন্যান্য দিনের তুলনায় গাড়ির চাপ থাকে বেশি। অন্যান্য দিনে গাড়ির তেমন চাপ থাকে না। মূলত অদক্ষ চালক, বেপরোয়া গতি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচলের জন্য এসব দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন টানেল কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে প্রশাসনের বিভিন্ন সংস্থার সাথে এ নিয়ে বৈঠক করেছে। যাতে টানেলে লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল করতে না পারে সেই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জন্য বলা হয়েছে।
২০১৩ সালের সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, টানেল চালুর বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করার কথা ছিল। চালুর বছর ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে ১ কোটি ৩৯ লাখ গাড়ি চলবে বলেও আভাস দেওয়া হয়, যার ৫০ শতাংশ হবে পণ্যবাহী গাড়ি।
প্রসঙ্গত, টানেল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল আট হাজার ৪৪৬ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা। পরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১০ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৪২ কোটিতে দাঁড়ায়। এর মধ্যে চীনের এঙ্মি ব্যাংক ২ শতাংশ সুদে ৫ হাজার ৯১৩ দশমিক ১৯ কোটি টাকা দিয়েছে। বাকি টাকা দেয় বাংলাদেশ সরকার।