- সারাদেশ
- বন্দর কাস্টমসে সক্ষমতা বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ
বন্দর কাস্টমসে সক্ষমতা বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ

চট্টগ্রাম বন্দর
দেশে আমদানি-রপ্তানির ৯২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে চট্টগ্রাম বন্দর। এ বন্দরের পণ্য শতভাগ শুল্ক্কায়ন করে চট্টগ্রাম কাস্টমস। চট্টগ্রাম বন্দর দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর। সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে। নতুন বছরে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে বন্দর ও কাস্টমসের সামনে। এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন সমকাল চট্টগ্রাম ব্যুরোর রিজিওনাল এডিটর সারোয়ার সুমন
বছর শেষেই জাতীয় নির্বাচন। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নানা কর্মসূচি নিয়ে আছে মাঠে। যে কোনো সময় উত্তপ্ত হতে পারে রাজনীতির মাঠ। অন্যদিকে বিশ্ব অর্থনীতিও অতিক্রম করছে ক্রান্তিকাল। যার প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও গতি ধরে রাখতে হবে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর ও সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠানকে। নতুন বছরে তাদের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। জাহাজের অপেক্ষমাণ সময় ও পণ্য পরিবহন ব্যয় কমাতে হবে। বাড়াতে হবে স্বচ্ছতা ও দক্ষ জনবল। আনতে হবে আধুনিক যন্ত্রপাতি। নিরসন করতে হবে শুল্ক্ক জটিলতাও। দেশের গুরুত্বপূর্ণ দুই প্রতিষ্ঠান এ চ্যালেঞ্জগুলো উতরে গেলে সুবাতাস বইবে অর্থনীতিতে। খোলা থাকবে সমৃদ্ধি স্বর্ণ দুয়ারও।
সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'নতুন বছরে উত্তপ্ত থাকতে পারে রাজনীতির মাঠ। এ বিষয়টি মাথায় রেখে এখনই কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে। পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর ও প্রধান রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজাতে হবে। রাজনীতির উত্তাপ যাতে গুরুত্বপূর্ণ এসব প্রতিষ্ঠানে প্রভাব না ফেলে, সে জন্য নির্ধারণ করে রাখতে হবে বিকল্পও। বন্দর থেকে সর্বোচ্চ দ্রুততম সময়ে পণ্য খালাসের ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। আধুনিক যন্ত্রপাতি বাড়াতে হবে। নিয়োগ দিতে হবে দক্ষ জনবলও।'
কমেছে পণ্যভর্তি কনটেইনার
চট্টগ্রাম বন্দরে ২০২১ সালে ২০ ফুট দীর্ঘ ৩২ লাখ ১৪ হাজার কনটেইনার ওঠানামা করে। কিন্তু ২০২২ সালে তা ছিল ৩১ লাখ ৪২ হাজার। অর্থাৎ কমে গেছে প্রায় আড়াই শতাংশ। অথচ এর আগে প্রায় এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছিল বন্দরের কনটেইনার ওঠানামা। বন্দরটিতে ২০১৭ সালে ২৬ লাখ ৬৭ হাজার ২২৩ কনটেইনার ওঠানামা করে। করোনা অতিমারির মধ্যেও ২০২০ সালে তা বেড়ে হয় ২৮ লাখ ৩৯ হাজার ৯৭৭।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, 'রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ডলার সংকট দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। মাঝে রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি কমে যাওয়া এবং আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় টান পড়ে রিজার্ভে। এ কারণে অতি জরুরি নয়, এমন অনেক পণ্যের আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। বছরের শেষদিকে তাই কমে যায় আমদানি। এর প্রভাবে গত বছর আগের বছরের অর্জনকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি চট্টগ্রাম বন্দর। তবে আগের বছরের কাছাকাছিই কনটেইনার হ্যান্ডেল করেছি আমরা।'
জাহাজ বেড়েছে, কার্গো পণ্যও বেড়েছে
কনটেইনার পরিবহন কমলেও গত বছর সার্বিক পণ্য পরিবহন আগের বছরের তুলনায় বেশি হয়েছে। ২০২২ সালে ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৬৫ হাজার ৬৮২ টন পণ্য পরিবহন হয়। ২০২১ সালে পরিবহন হয় ১১ কোটি ৬৬ লাখ। এই হিসাবে পণ্য পরিবহন বেড়েছে ২ শতাংশের কিছু বেশি। গত এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে কার্গো পণ্যের পরিমাণ। ২০২০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে কার্গো পণ্য আসে ১০ কোটি ৩২ লাখ ৯ হাজার টন। এটি ২০১৯ সালে ছিল ১০ কোটি ৩০ লাখ ৭৭ হাজার টন। শুধু কার্গো পণ্য নয়, জাহাজ আসার পরিমাণও আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে ২০২২ সালে। সর্বশেষ বছরে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ এসেছে ৪ হাজার ৩৬১টি। ২০২১ সালে আসে ৪ হাজার ৫৪টি।
বাড়াতে হবে সক্ষমতা
নৌবাণিজ্যে গতি আনতে গত বছর পতেঙ্গা টার্মিনাল নির্মাণ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। কাজ শুরু হয়েছে বে-টার্মিনাল নামে নতুন আরেকটি বন্দরের। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের খেজুরতলার বিপরীত দিক থেকে কাট্টলী পর্যন্ত অংশে পলি জমে ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি চর সৃষ্টি হয়েছে। এই চরেই নির্মাণ হচ্ছে বে-টার্মিনাল। এটি তৈরি হলে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বেড়ে যাবে তিন গুণ। চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলে দিনে জোয়ারের সময় সর্বোচ্চ চার ঘণ্টা সময়ে এখন ৯ দশমিক ৫০ মিটার ড্রাফট ও ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজ চলাচল করতে পারে। বে-টার্মিনাল নির্মিত হলে দিন-রাতের যে কোনো সময়ে এর চেয়ে অনেক বেশি দৈর্ঘ্য ও ড্রাফটের জাহাজ নোঙর করতে পারবে।
চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে আসা জাহাজগুলো সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮০০ কনটেইনার বহন করতে পারে। বে-টার্মিনালে ৫ হাজার কনটেইনারবাহী জাহাজও ভিড়তে পারবে। এ টার্মিনালের বিভিন্ন জেটিতে একসঙ্গে ৩০ থেকে ৩৫টি জাহাজ নোঙর করতে পারবে। কয়লা, জ্বালানি তেল ও ক্লিঙ্কারের জন্য আলাদা জেটি থাকবে বে-টার্মিনালে। ২০২৩ সালের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করতে চায় বন্দর কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, বে টার্মিনাল প্রকল্পের জন্য ৬৭ একর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির দখল বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরও ৮০৩ একর জমি নামমাত্র মূল্যে বন্দরের অনুকূলে বরাদ্দ দিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভূমি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে চলতি অর্থবছরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যন্ত্রপাতিও আসবে বলে জানান তিনি।
এদিকে শুল্ক্কায়ন প্রক্রিয়ায় গতি আনতে স্ক্যানারের সংখ্যা বাড়াতে হবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে। এখন চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ স্ক্যানার আছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এতে পণ্য শুল্ক্কায়নে সময় লাগছে বেশি। ঘটছে শুল্ক্ক ফাঁকির ঘটনাও। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ স্ক্যানারের সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে চিঠি দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআরে)। নিজস্ব উদ্যোগে স্ক্যানার যুক্ত করছে বন্দর কর্তৃপক্ষও।
নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি চট্টগ্রামের ১৯ আইসিডি
নতুন বছরে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বেসরকারি ১৯ আইসিডি কর্তৃপক্ষকেও। বন্দর ও কাস্টমসের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকায় সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তারাও। কনটেইনারের পরিমাণ কমে যাওয়ায় সর্বশেষ চার মাসে প্রায় ১৭০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে তাদের।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান জানান, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ২২ হাজার ৭৬৬ টিইইউএস, অক্টোবরে ২৩ হাজার ১৯৩ টিইইউএস ও নভেম্বরে ১৯ হাজার ৭৩৭ টিইইউএস পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ২০ হাজার ৬৭৩ টিইইউএস, অক্টোবরে ২০ হাজার ২৩০ টিইইউএস ও নভেম্বরে ২০ হাজার ৩৮৪ টিইইউএস পণ্য রপ্তানি করেন তাঁরা।
তিনি বলেন, ডলার সংকটের কারণে আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। আবার পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিও কমে গেছে। রপ্তানিযোগ্য পণ্যের উৎপাদনও কমে গেছে। এসব কারণে গত চার মাসে আমদানি ও রপ্তানি প্রায় ২০ শতাংশ কমে গেছে। ডিপোগুলোতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। নতুন বছরে ব্যবসা চাঙ্গা করতে প্রয়োজন হবে নতুন কর্মকৌশল।
কাস্টমসকে বাড়াতে হবে রাজস্ব
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের ৯২ ভাগ আমদানি-রপ্তানি পণ্য আসে। আবার সরকারের রাজস্ব আদায়ের বড় অংশ আসে এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। তাই রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলেও কোনোভাবেই অচল করা যাবে না চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস রাজস্ব আদায় করেছে ৩০ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এটি ৮৯৫ কোটি টাকা বেশি হলেও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম। ওই ছয় মাসের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। অর্থবছরের পরের ছয় মাসে ঘাটতি পূরণ করে ৭৪ হাজার ২০৬ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে হবে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসকে।
মন্তব্য করুন