বাগেরহাট সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নের ভৈরব নদের পাশে ভাতছালা-মুনিগঞ্জ বেড়িবাঁধ নির্মাণ হয় ষাটের দশকে। তবে দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় কাজে আসছিল না এটি। জোয়ারে এলাকা প্লাবিত হওয়ায় পানিবন্দি হয়ে পড়তেন বাসিন্দারা। দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের নভেম্বরে তিন কিলোমিটার বাঁধ উঁচু করে নির্মাণকাজ শুরু করে বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এতে মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধের সংস্কারকাজে অনেক স্থানে ব্যবহার করা হচ্ছে বালু। স্থানীয়দের বসতবাড়ি ও জমি থেকে মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। বাঁধের গোড়া ও বালুচরও কাটা হচ্ছে। এতে নির্মাণকাজ শেষের আগে কয়েকটি অংশে ফাটল ও ধসে যেতে শুরু করেছে। অনেকের জমি থেকে মাটি নেওয়া হলেও টাকা দেওয়া হচ্ছে না। এ নিয়ে প্রভাবশালী স্থানীয় ঠিকাদার এবং পাউবোর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা।
তবে বাঁধে কোথাও বালু খুঁজে পায়নি বলে দাবি করেছে পাউবো। তাদের দাবি, বাঁধের ঢাল শেষে নির্মাণ হবে। তাই এখনই ধসের কথা বলা যাবে না। পাউবোর তথ্য অনুযায়ী, জরুরি ভিত্তিতে নাজিরপুর উপপ্রকল্পের অধীন ডিপিএম বা সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে বাঁধ তৈরির কাজ পেয়েছেন শেখ শহিদুল ইসলাম নামে এক ঠিকাদার। ব্যয় ধরা হয়েছে ৯০ লাখ টাকা। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে ৫২ ভাগ কাজ। চলতি মাসে কাজ শেষের কথা থাকলেও সময় বাড়ানো হবে বলে জানা গেছে।
গত শুক্রবার বাঁধ এলাকার মুনিগঞ্জ খেয়াঘাট থেকে লোকাল বোর্ড খেয়াঘাট পর্যন্ত বাড়ি, বাগান ও মাঠে অন্তত ৫০টি গর্ত দেখা যায়। বিপরীত পাশে নদের চরের অধিকাংশ গর্ত বাঁধ লাগোয়া। মাটি-বালু দিয়ে বাঁধের মাঝে ফাঁকা রেখে দু'পাশে উঁচু আইলের মতো রাখা হয়েছে। কিছু অংশ ভরাট করা হয়েছে বালু দিয়ে। এর কয়েকটি স্থানে দেখা দিয়েছে ফাটল ও ধস। পাউবোর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাঁধের একদম টোরের (গোড়া) দেড় মিটার দূরে ছাড়া মাটি কাটা উচিত নয়। তবে চরের মাটি কাটলে আবার পলি জমে ভরাট হওয়ায় অসুবিধা নেই।
বাঁধ নির্মাণের অনিয়মের বিষয়ে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছেন স্থানীয়রা। তবে পাউবো অফিসে গিয়ে কয়েকজন একাধিকবার শিডিউল দেখতে চাইলেও দেখানো হয়নি। সংবাদকর্মী হিসেবে এ প্রতিবেদক গত রোববার শিডিউল চাইলে দিতে অপারগতা প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাউবোর এক কর্মী বলেন, এ কাজের কোনো শিডিউল নেই। কাজ শেষ হলে চার্ট করে আগের তারিখ দিয়ে জমা রাখা হবে।
বাড়ির পাশে গর্ত করে মাটি নেওয়ায় চরগা গ্রামের ফাতেমা জোহরা নামের এক নারীর বাড়ির উঠানে ফাটল দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, বাড়ির সামনে উঁচু রাস্তা হবে বলে মাটি দিতে রাজি হন। জায়গা দেখিয়ে অনুরোধ করেছিলেন সেখান থেকে নিতে। কিন্তু জোর করে গাছপালা তুলে বাড়ির কাছে গর্ত করে মাটি নিয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা টিটো শেখ বলেন, যেভাবে মাটি নিয়েছে, বসবাস করা যাচ্ছে না। এত বছর পরে হলেও বৃষ্টি-জোয়ারে প্লাবিত হওয়া থেকে মুক্তির আশা করেছিলেন। তবে কাজ দেখে সব আশা শেষ, আগের চেয়ে অবস্থা খারাপ হবে। শাহজাহান শেখ বলেন, বাঁধ টেকার কোনো সুযোগ নেই, পানি বাড়লে নদীতে চলে যাবে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বেমরতা ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আসাদুজ্জামান মোহনের চাচাতো ভাই সুমন, চরগা গ্রামের মো. ফারুক হোসেন ফকির ওরফে ছোটসহ স্থানীয় কয়েকজন প্রভাব খাটিয়ে মাটি দিতে বাধ্য করছেন। তবে মারুফ হোসেন বলেন, ইউপি সদস্য বলায় তিনি মাটি কাটার সময় ছিলেন। সবাই স্বেচ্ছায় মাটি দিচ্ছে, কাউকে চাপ দেওয়া হয়নি। তবে বাঁধ টেকা নিয়ে সন্দেহ আছে তাঁরও।
বেমরতা ইউপির প্যানেল চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মোহন বলেন, বাঁধ-সংক্রান্ত কাজে তাঁর কোনো সংশ্নিষ্টতা নেই। এলাকার কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সমাধানের চেষ্টা করবেন।
ঠিকাদার শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, ২২ বছর পর বাঁধের সংস্কার হচ্ছে। এটি জরুরি কাজ। গ্রামবাসীর সহযোগিতায় কাজটা করছেন। মাটি কিনে নেওয়ার বরাদ্দ শিডিউলে নেই।
দুই কিলোমিটার হেঁটেও বালুর দেখা পাননি বলে দাবি করেছেন পাউবোর বাগেরহাট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুম বিল্লাহ। তিনি বলেন, বাঁধ নির্মাণের মাটি স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে। দরপত্র অনুযায়ী, বাঁধের কোথাও দুই ফুট, আবার কোথাও চার ফুট উঁচু হবে। জরুরি ফান্ড থেকে কাজটি করা হচ্ছে। মাটি ছাড়া লোকাল ম্যাটেরিয়াল স্যান্ড (বালু) ব্যবহার হতে পারে। তবে মাটি বেশি থাকবে।