আগে যেখানে ছিল টিলা, সেখানে এখন নতুন নতুন প্লট। এসব প্লট বিক্রি করা হচ্ছে রেজিস্ট্রি ছাড়াই। শুধু স্ট্যাম্পের মাধ্যমেই বিক্রি হচ্ছে খাস কিংবা চা বাগানের জন্য সরকারের লিজ দেওয়া জমি। কোটি কোটি টাকার সরকারি জমি অবাধে বিক্রি করে দিচ্ছে দালালরা। সরকার এতে রাজস্বও পাচ্ছে না। এসব জমি বিক্রিতে কৌশল হিসেবে এলাকার নামকরণ করা হয়েছে দালালদের নামে। প্রকাশ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও প্রশাসন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

কাগজে একটি এলাকার নাম কুলি বস্তি। এই এলাকার জমি বিক্রিতে উল্লেখ করা হয় দালাল সিরাজের নামে সিরাজনগর (৩ নম্বর কুলি বস্তি) ও তার ছেলে সবুজের নামে সবুজনগর হিসেবে। পার্শ্ববর্তী ৯ নম্বর কুলি বস্তির নামকরণ করা হয়েছে জাহাঙ্গীর নামে একজনের মা ফাতেমা বেগমের নামে ফাতেমানগর। এসব ঘটনা ঘটছে সিলেট সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে।

বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায়, সদর উপজেলার খাদিমপাড়া ইউনিয়নের বহর মৌজার ১ ও ২ নম্বর খতিয়ানের ৩৮ একর ৩৪ শতক খাসজমি নিয়ে ওই এলাকার নাম বহর কলোনি। নাম পরিবর্তন করে ভূমিখেকো চক্র বহর আবাসিক এলাকা ও আল বারাকা গ্রিন সিটি নাম দিয়ে স্ট্যাম্পের মাধ্যমে প্লট বিক্রি করছে। এতে জড়িত বাগানের কিছু লোক, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও কয়েকজন জনপ্রতিনিধি।

বহর মৌজার কয়েকটি দাগে প্রায় ১৫ একর খাসজমির মধ্যে ওসমানী মুক্তিযোদ্ধা গুচ্ছগ্রামকে কিছু জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। কিন্তু বন্দোবস্তের শর্ত ভঙ্গ করে খাসজমি স্ট্যাম্পের মাধ্যমে বিক্রি করা হচ্ছে। এসব এলাকায় এখন দালানকোঠা গড়ে উঠেছে। খাদিমপাড়া ইউনিয়নের মেজরটিলা থেকে বটেশ্বর পর্যন্ত রয়েছে বেশ কয়েকটি চা বাগান। এসব বাগান এলাকার আশপাশে রয়েছে বিভিন্ন দাগে খাসজমি। কিছু এলাকায় খাসজমিতে বাস করছেন ১৯৬৪ সালে ভারত থেকে আসা মোহাজিররা। তাদের সরকারিভাবে থাকার জন্য খাদিম, বাহুবলসহ বিভিন্ন এলাকায় মোহাজির কলোনি তৈরি করে দেওয়া হয়। বর্তমানে অনেক খাসজমি মোহাজিরদের দখলে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লোকজন এবং মোহাজিররা মিলে খাদিমপাড়া ও খাদিমনগর এলাকায় গড়ে তুলেছে বিশাল সিন্ডিকেট।

১৯৯৭ সালে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে দেওয়া সিলেট সদরের কানুনগো স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে ভারত থেকে আসা মোহাজিরদের উল্লেখিত জায়গা থেকে ৮ একর ৪ শতক ভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু বাকি ৩০ একর ৩০ শতক জমিতে নজর পড়ে স্থানীয় খন্দকার আনোয়ার হোসেন, আইয়ূব আলী, সিরাজ মিয়া, আমির মিয়া, উছমান আলী, করিম হাজারী, কয়েস মিয়া, রুস্তম আলী, ইউনুছ আলী, সাইফুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম, আবুল কালাম আজাদ পাটোয়ারি ও আলী মুসলিম মিয়াদের। তাদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই স্ট্যাম্পে বিক্রি হচ্ছে সরকারের লিজ দেওয়া চা বাগানের জমি ও খাসজমি।

গত কয়েক বছরে হাজার কোটি টাকার খাসজমি স্ট্যাম্পের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে। পাহাড়-টিলা, বন ও চা বাগান কেটে প্লট সৃষ্টি করে বিক্রি করা হচ্ছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন,এলাকাগুলোতে বিভিন্ন মৌজার জায়গা ও চা বাগানের অংশ ধীরে ধীরে কেটে দখল ও বিক্রি করা হচ্ছে। এ জন্য ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কিছু জাল কাগজও তৈরি করেছে ওই সিন্ডিকেট। অবৈধ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে স্থানীয়রা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে এলেও প্রশাসন থেকে কোনো প্রতিকার পাননি।

দিনমজুর সিরাজ মিয়া ১৯৯৫ সালে বহর মৌজার অন্তর্ভুক্ত ১৪২ নম্বর দাগের খাসজমিতে ছনের ঘর তৈরি করে বাস করতেন। পরে খাদিমনগর টি-গার্ডেন মৌজার বিভিন্ন দাগে কয়েকটি কুঁড়েঘর তৈরি করে দখল বাণিজ্য শুরু করেন। এর পর থেকেই পাল্টে যান সিরাজ। নিজেকে এই এলাকার কর্ণধার দাবি করে বিভিন্ন শ্রেণি- পেশার মানুষের কাছে স্ট্যাম্পের মাধ্যমে সরকারি জমি বেচাকেনা করছেন তিনি।

স্থানীয় লোকজন জানান, ভূমিখেকোরা খুবই প্রভাবশালী। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারও নেই। কেউ যদি তাদের এই অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তাহলে তাকে হামলা-মামলার সম্মুখীন হতে হয়। ক্ষমতার দাপটে ইচ্ছা হলে জনবসতি উচ্ছেদ করে, আবার ইচ্ছা হলে নতুন বসতি গড়ে দেয়।

এ ব্যাপারে খাদিম চা বাগানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল রশিদ চৌধুরী জানান, ভূমিখেকো চক্র টিলা কাটা থেকে শুরু করে নানা অপকর্ম করছে। পুলিশ, ইউএনও, সিলেট বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তর ও ডিসি অফিসে বারবার তিনি অভিযোগ দিয়েছেন। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আফজাল রশীদ। কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১১ সালে সিলেট সদর উপজেলার খাদিমনগর টি-গার্ডেন মৌজার জেএল নম্বর সাবেক ৭১, হাল ৭১ ও দেবপুর মৌজার জেএল নম্বর সাবেক ৯৬, হাল ৮১-এ ইজারাধীন জমি সর্বমোট ১৮০১ একর ৫৬ শতক। ওই জমি ইজারার জন্য সরকারের কাছে নীনা-আফজাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পক্ষে আবেদন করেন আফজাল রশিদ চৌধুরী। যাচাই-বাছাই করে সিলেটের জেলা প্রশাসক ২০১২ থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত ২০ বছরের জন্য ইজারা দেন আফজাল রশীদ চৌধুরীকে।

সিরাজনগর আবাসিক এলাকার প্রতিষ্ঠাতা সিরাজ মিয়া দাবি করেন, তাঁর নিয়ন্ত্রিত জায়গা তাঁর বাবা ফুলবাড়ির জমিদার আবদুল মামুন চৌধুরীর কাছ থেকে কিনেছেন। বর্তমানে জায়গা নিয়ে আদালতে মামলা চলছে।

এ ব্যাপারে সিলেট সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা (এসিল্যান্ড) মো. সম্রাট হোসেন সমকালকে বলেন, 'আমরা অনেক অভিযোগ পেয়েছি। এসব অভিযোগের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। ইউএনও প্রশিক্ষণে গেছেন। তিনি এলে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।'