
আগৈলঝাড়ার রাজিহার ইউনিয়নের রামানন্দের আঁক গ্রামে রোববার মারবেল মেলায় অংশ নেন সব বয়সের লোকজন - সমকাল
প্রায় সাত কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চলছে মারবেল খেলা। রাস্তার ওপর, বাড়ির আঙিনা, অনাবাদি জমি, বাগানসহ সর্বত্রই খেলার আসর বসেছে। শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সের মানুষ মারবেল খেলায় ব্যস্ত। পাশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে বসেছে বাঁশ-বেত শিল্প, মনিহারি, খেলনা, মিষ্টি, ফলসহ বিভিন্ন ধরনের দোকান। গতকাল রোববার এমন দৃশ্যের দেখা মেলে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের রামানন্দের আঁক গ্রামে।
প্রতিবছর পৌষ সংক্রান্তিতে গ্রামটিতে এ মেলা বসে। স্থানীয় বাসিন্দারা এ উপলক্ষে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাঁদের মেয়ে জামাইসহ আত্মীয়স্বজনকে। মেলা ঘিরে রামানন্দের আঁক গ্রামজুড়ে ছিল উৎসবের আমেজ। গ্রামীণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে ২৪৩ বছর ধরে চলছে মারবেল মেলা। এতে শুধু আগৈলঝাড়া নয়, পাশের কোটালীপাড়া, উজিরপুর, ডাসার, মাদারীপুর, কালকিনী, গৌরনদী, বানারীপাড়া ও বাকেরগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানের হাজারো মানুষ আসেন।
শরীয়াতপুর জেলার নড়িয়া উপজেলা থেকে মারবেল খেলার জন্য এসেছিলেন সৈকত বিশ্বাস। বাগধা গ্রাম থেকে নমিতা মণ্ডল আসেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে। তাঁরা জানান, মেলায় এসে মারবেল খেলতে পেরে তাঁদের ভালো লাগছে। মারবেল খেলার রহস্য সম্পর্কে স্থানীয় চিত্ররঞ্জন বিশ্বাস (৮০) জানান, পূর্বপুরুষরা এ খেলার মাধ্যমে মেলার প্রচলন করেন।
মেলা কমিটির সভাপতি রামকৃষ্ণ হালদার জানান, মেলা উপলক্ষে বৈষ্ণব সেবা, নাম সংকীর্ত্তন ও কবিগান হয়। পরে সোয়া মণ (৫০ কেজি) চালের গুঁড়ার সঙ্গে সোয়া মণ আখের গুড়, ৫০ জোড়া নারকেল ও প্রয়োজনীয় কলাসহ অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে নবান্ন তৈরি করেন। তা প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয় মেলার দর্শণার্থীদের। পৌষ সংক্রান্তিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাস্তুপূজা উপলক্ষে মারবেল মেলাটি হয়ে আসছে।
কোটালীপাড়া থেকে মেলায় আসা প্রভাষক তরুণ চন্দ্র নাথ (৪০) জানান, এলাকার ঐতিহ্যবাহী মারবেল খেলার কথা শুনে এসেছেন তিনি। কোদালধোয়া গ্রামের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র নয়ন হালদার ও দশম শ্রেণির উত্তম রায় জানায়, তারা সারা বছর টাকা জমিয়েছে মারবেল খেলার জন্য।
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক এবং সোনাই চাঁদ আউলিয়া মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিশ্বাস বাড়ির বিধান বিশ্বাস বলেন, ২৪৩ বছর আগে রামানন্দের আঁক গ্রামে মা সোনাই চাঁদ আউলিয়ার ছয় বছর বয়সে বিয়ে হয়। সাত বছর বয়সে স্বামী মারা গেলে নিঃসন্তান অবস্থায় শ্বশুরবাড়িতে নিমগাছের গোড়ায় শিবের আরাধনা ও পূজা-অর্চনা শুরু করেন। তাঁর অলৌকিকত্ব ছড়িয়ে পড়লে সেখানে বার্ষিক পূজার আয়োজন করা হয়। মন্দিরে মানত করলে মনের বাসনা পূরণ হয়।
সোনাই চাঁদ আউলিয়ার জীবদ্দশায় আনুমানিক ১৭৮০ সাল থেকে শুরু হয় মেলা। এখনও প্রতিবছর পৌষ সংক্রান্তির দিনে সংস্কৃত গান, বৈষ্ণব সেবা, নিরামিশ খাবার, নবান্ন উৎসব, মারবেল মেলা হয়ে আসছে। তাঁর মৃত্যুর পরে বাড়িটি মা সোনাই চাঁদ আউলিয়ার বাড়ি হিসেবে এলাকায় পরিচিতি পায়। মেলা উপলক্ষে বাড়িটির মেয়ে শিখা বিশ্বাস পরিবারসহ ঢাকা থেকে এসে অংশগ্রহণ করেন।
আগৈলঝাড়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাজহারুল ইসলাম বলেন, মেলা পরিচালনার জন্য ৪০ সদস্যের উদযাপন কমিটি গঠন করা হয়। অনেকে দূর থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মারবেল মেলা জনপ্রিয় করতে মেলাস্থলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিসহ মাঠ সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন।
মন্তব্য করুন