বহুল আলোচিত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনার প্রকল্পটি উপস্থাপন করা হয়নি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে। এ নিয়ে বৈঠকে কোনো আলোচনাও হয়নি। ফলে আগামী বছরের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণ করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের যে পরিকল্পনা- তা নিয়ে সংশয় থেকেই গেল।

গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত একনেক বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে প্রকল্প ব্যয়ে আরও সচেতন এবং সাশ্রয়ী হওয়ার নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেছেন, যেসব প্রকল্প থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা বেশি পাওয়া যাবে, সেসব প্রকল্পে খরচ করা যাবে। এ ধরনের প্রকল্পে খরচ বন্ধ না করার কথা বলেছেন তিনি। বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে আবাদ ও উৎপাদন উৎসাহিত করতে সবাইকে কাজ করার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠক শেষে এক ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন নির্দেশনা এবং একনেকের অন্যান্য প্রসঙ্গে বিস্তারিত তুলে ধরেন পরিকল্পনামন্ত্রী।

ইভিএম প্রসঙ্গ :নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রস্তাবিত 'নির্বাচন ব্যবস্থায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার বৃদ্ধি এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা' নামে প্রকল্পটি একনেকে উপস্থাপনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল না। নিয়ম অনুযায়ী, কোনো প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে এলে সংশ্নিষ্ট বিভাগ যাচাই-বাছাই করে থাকে। এ বিষয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) বৈঠকে আলোচনা-পর্যালোচনা হয়ে থাকে। এখন পর্যন্ত ইভিএম প্রকল্পের পিইসি হয়নি। সে হিসেবে গতকালের একনেকে প্রকল্পটি ওঠার কথাও ছিল না।

তবে 'টেবিলে উপস্থাপিত' হিসেবে প্রকল্প অনুমোদনের নজির আছে। প্রকল্পটি একনেকে উপস্থাপনের জন্য গত কয়েক দিন ইসি বেশ তৎপর ছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত না হলেও ইভিএম প্রকল্পটি একনেকে উঠতে পারে বলে একটি জাতীয় দৈনিকে খবর বেরিয়েছিল। একজন প্রতিমন্ত্রী আভাস দিয়েছিলেন, একনেক সভায় ইভিএম প্রকল্পটি উঠতে পারে।

নির্বাচন কমিশন আগেই জানিয়েছিল, মধ্য জানুয়ারির মধ্যে এ প্রকল্প অনুমোদন না হলে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট নেওয়া সম্ভব হবে না। সে হিসেবে গতকালের একনেকে প্রকল্পটি অনুমোদিত না হওয়ায় অনেকে মনে করছেন, উল্লিখিত আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, 'ইভিএম কেনার প্রকল্পটি একনেকের তালিকায় ছিল না। এ নিয়ে বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কিছু জানতেও চাননি। তিনি যেহেতু জানতে চাননি, সে কারণে আমরা স্বপ্রণোদিত হয়ে কিছু জানাতেও চাইনি। তবে ইভিএম প্রকল্পটি প্রক্রিয়াধীন।'

প্রসঙ্গত, রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি ইভিএমে ভোট গ্রহণের বিরোধিতা করে আসছে। ওদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ইভিএমে ভোটের পক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করে আসছে। এ নিয়ে রাজনীতির মাঠও বেশ সরগরম। রাজনীতির বাইরে সুশীল সমাজেও ইভিএম নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ মত বেশ প্রবল।

সার্বিক অর্থনীতি :একনেক বৈঠকে অর্থনীতির সার্বিক চালচিত্র তুলে ধরা হয় পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে। এতে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নিয়ে আশাবাদের কথা বলা হয়। এ বিষয়ে ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় গত ছয় মাসে পণ্য রপ্তানি দুই বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের মতো। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রয়েছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ঋণ পরিশোধের পর রিজার্ভ আছে ৩২ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে গত চার মাস মূল্যস্ম্ফীতি কমছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে মন্দার পূর্বাভাস সত্ত্বেও অর্থনীতির সব সূচক ইতিবাচক বলে তিনি জানান।

অর্থনীতি এত ভালো, তাহলে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হচ্ছে কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, 'আমরা কথামালা সাজাই না। যা বলি তা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলি।' ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হচ্ছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ শতাংশ এখন ভর্তুকি। এই হার কমাতে হবে। তবে কৃষি খাতে ভর্তুকি আগের মতোই থাকছে। গত ছয় মাসে ১ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণের প্রকল্প অুনমোদন হয়েছে। আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা জানান তিনি।

১১ প্রকল্প অনুমোদন :একনেকে মোট ১১টি প্রকল্প অনুমোদিত হয়। এসব প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়ছে ১০ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা বিদেশি ঋণ। বাকি ৭ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব। অনুমোদিত প্রকল্পের মধ্যে ব্যাপক সমালোচিত হাওরে উড়াল সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটিও রয়েছে। কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলা সদর থেকে করিমগঞ্জ উপজেলার মচিখালী পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের উড়াল সড়ক নির্মাণসহ আরও কিছু কম প্রয়োজনীয় স্থাপনা রয়েছে প্রকল্পটিতে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, প্রকল্পটি হাওরের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট করবে। অর্থ সংকটের সময়ে ৫ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি এ মাসেই কার্যক্রম শুরু করতে চায় বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেতু কর্তৃপক্ষ। মন্দাকালে এ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনা সচিব সত্যজিত কর্মকার বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক সংকট সাময়িক। দীর্ঘ মেয়াদে এই সংকট থাকবে না। এ ছাড়া চলতি অর্থবছর মাত্র ৭৬ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে প্রকল্পটিতে, যা ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় হবে। অর্থাৎ দেশের টাকা দেশেই থাকছে। প্রকল্পটির চূড়ান্ত কার্যক্রমে বিভিন্ন খাতে ব্যয় কমানোর সুযোগ রয়েছে বলে জানান তিনি।

অনুমোদিত অন্য প্রকল্প হচ্ছে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার শ্রীমাই নদীতে মাল্টিপারপাস হাইড্রোলিক এলিভেটেড ড্যাম নির্মাণ। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। বরিশালের কারখানা বিঘাই ও পায়রা নদীর ভাঙন থেকে শেখ হাসিনা সেনানিবাস এলাকা রক্ষা প্রকল্প। প্রকল্পটিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৭৬ কোটি টাকা। ঢাকার দোহার উপজেলাধীন মাঝিরচর থেকে নারিশাবাজার হয়ে মোকসেদপুর পর্যন্ত পদ্মা নদী ড্রেজিং ও বাম তীর সংরক্ষণ প্রকল্পে নতুন করে ব্যয় বাড়ানো হয় ৫২৮ কোটি টাকা। এটি প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় ছোট দ্বীপ এবং নদীর চরের জন্য অভিযোজন উদ্যোগ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৮ কোটি টাকা। মাতারবাড়ী কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৩৬৫ কোটি টাকা। এটি প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহু লেন সড়ক টানেল নির্মাণ প্রকল্পের নতুন করে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৩১৫ কোটি টাকা। এটিও এই প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী। এ ছাড়া স্টাবলিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিসট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম প্রকল্পটি তৃতীয়বারের মতো সংশোধন করা হয়েছে। নতুন করে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৯২ কোটি টাকা। ২৫টি শহরে অন্তর্ভুক্তিমূলক স্যানিটেশন প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ২১১ কোটি টাকা। এটি নতুন প্রকল্প। খুলনায় ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাডপ্টেড আরবান ডেভেলপমেন্ট পেজ-২ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৯১ কোটি টাকা ও ঘোড়াশাল চতুর্থ ইউনিট রি-পাওয়ারিং প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা।

গতকাল একনেক বৈঠক হয় রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলন কক্ষে। পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, তথ্য ও সম্প্র্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন এবং সংশ্নিষ্ট প্রতিমন্ত্রী ও সচিবরা সভার কার্যক্রমে অংশ নেন।