- সারাদেশ
- আর্থিক ক্ষমতায় না, উন্নয়ন প্রকল্প তদারকিতে হ্যাঁ
ডিসি সম্মেলন
আর্থিক ক্ষমতায় না, উন্নয়ন প্রকল্প তদারকিতে হ্যাঁ

ডিসি সম্মেলনে জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে আসা অনেক প্রস্তাবের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে সরকার। তবে কিছু প্রস্তাবে আইন ও বিধি-সংক্রান্ত ভিন্নতা থাকায় নাকচ করা হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে মাঠ পর্যায়ে বরাদ্দ দেওয়া প্রকল্পের আর্থিক ক্ষমতা ডিসিদের দিতে একাধিক জেলা থেকে প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু এ-সংক্রান্ত ক্ষমতা তাঁদের হাতে দেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে সরকার। তবে উন্নয়ন প্রকল্প তদারকির ক্ষেত্রে ডিসিদের ভূমিকা পালন আরও বাড়ানোর তাগিদ সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে তিন দিনের ডিসি সম্মেলন। এতে ৬৪ জেলার ডিসিসহ আট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিশনাররা উপস্থিত ছিলেন। ডিসিদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের আনুষ্ঠানিক মতামত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানানোর পর এ-সংক্রান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে।
স্থানীয় প্রশাসনে সরকারি কার্যক্রমের সার্বিক দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন ডিসিরা। সম্মেলনে ডেপুটি কমিশনারদের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলোর অন্যতম ছিল বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দকৃত প্রকল্পের আয়ন-ব্যয়ন ক্ষমতা পাওয়া। সম্মেলনে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বাস্তবায়িত উন্নয়ন প্রকল্পের মান খারাপ হলে সে বিষয়ে কার্যত জেলা প্রশাসনকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে আর্থিক ক্ষমতা ডিসিদের হাতে না থাকায় তাঁদের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না।
পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলার ডিসির পক্ষ থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দকৃত অর্থে উন্নয়ন প্রকল্পের আয়ন-ব্যয়ন ক্ষমতা দেওয়ার লিখিত প্রস্তাব ছিল। প্রস্তাবের পক্ষে একাধিক যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ দেওয়া টাকায় ডিসি অফিস, সার্কিট হাউস, ডিসির বাসভবনসহ জেলা পর্যায়ের ছয় তলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ে বারো তলা সাকির্ট হাউস, কনভেনশন সেন্টার গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়। এতে প্রকল্পের প্রাক্কলন, নকশা, মনিটরিং এবং গুণগত মান বজায় রেখে প্রকল্প বাস্তবায়ন সমস্যা হয়।
এসব কাজে ডিসিরা আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পেলে প্রকল্পের মনিটরিং সহজ হবে এবং কাজের গুণগত মান বজায় রেখে বাস্তবায়ন সহজ হবে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত অধিবেশনেও এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। গোপালগঞ্জের ডিসি কাজী মাহবুবুল আলমের প্রস্তাবে প্রতিটি দপ্তরের রক্ষণাবেক্ষণ বাজেট স্ব-স্ব দপ্তরে বরাদ্দের কথা বলা হয়। এ প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি লিখিত প্রস্তাবে বলেন, সংশ্নিষ্ট দপ্তরকে রক্ষণাবেক্ষণ বাজেট দিলে এসব কাজ দ্রুত ও কার্যকরভাবে সম্পন্ন হওয়া সম্ভব।
ডিসিদের এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সমকালকে বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত যত প্রস্তাব ছিল, সেগুলোর অনেক বিষয়েই আমরা বিবেচনাধীন রেখেছি। প্রয়োজন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে প্রকল্পের আয়ন-ব্যয়ক কর্মকর্তার দায়িত্ব তাঁদের দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, অ্যালোকেশন অব বিজনেস অনুযায়ী এই দায়িত্ব গণপূর্ত পালন করে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, ডিসিরা জেলার সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেন। সে হিসেবে তাঁদের হাতে আর্থিক ক্ষমতা থাকা উচিত। তাঁরা প্রকল্পগুলো তদারক করার দায়িত্ব পালন করেন, আর্থিক ক্ষমতা না থাকায় প্রকল্প-সংক্রান্ত মৌলিক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, হাওর এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কাজে জেলা প্রশাসন তদারকির কাজ করে। বাঁধের কাজে আর্থিক ক্ষমতা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের হাতে। কিন্তু হঠাৎ বন্যায় যখন বাঁধ ভেঙে যায় তখন গণমাধ্যমে জেলা প্রশাসনকে সমালোচনা করে রিপোর্ট হয়।
এর বাইরে আরও কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণ করেনি সরকার। অন্তত ছয়টি জেলার ডিসির পক্ষ থেকে নিজ নিজ জেলায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব সম্মেলনে উত্থাপন হয়। এরই মধ্যে দেশে বেশ কিছু অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ চলমান থাকায় নতুন করে এ ধরনের উদ্যোগে যেতে যাচ্ছে না সরকার। এর পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলা হয়েছে, যেসব ইকোনমিক জোন অনুমোদিত আছে সেগুলোর সব জায়গা এখনও ঠিকমতো কাজে লাগানো যাচ্ছে না। তাই নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিষয়ে এখনই চিন্তা করছে না সরকার। এ ছাড়া সব বিভাগে কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর স্থাপনের প্রস্তাবেও সাড়া পায়নি।
তবে উন্নয়ন প্রকল্পে তদারকির বিষয়ে ডিসিদের দায়িত্ব আগের চেয়ে আরও বাড়ানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একাধিক ডিসি বলেন, জেলার উন্নয়ন প্রকল্প তদারক করা ডিসিদের নিয়মিত কাজ। এ বিষয়ে নির্দেশনা থাকায় আরও বেশি উদ্যোগ নিতে সমস্যা নেই। কিন্তু কার্যকর সমন্বয়ের জন্য আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তার ক্ষমতাও থাকা দরকার।
যেসব প্রস্তাবে ইতিবাচক সরকার: জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি প্রস্তাবে ইতিবাচক মনোভাব পেয়েছেন ডিসিরা। এর মধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) আবাসিক কার্যালয়ে জনবল বৃদ্ধি, পার্বত্য এলাকার জেলা ও উপজেলা প্রশাসনে পাহাড়ি এলাকায় চলাচল উপযোগী গাড়ি এবং স্পিডবোটসহ ট্রেজারি ভবন নির্মাণের প্রস্তাবগুলো বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
নরসিংদীর ডিসি আবু নইম মোহাম্মদ মারুফ সরকারি চাকরিজীবীদের সন্তানদের শিক্ষা সহায়ক ভাতা, চিকিৎসা ভাতা ও ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীদের টিফিন ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। সম্মেলন সূত্রে জানা গেছে, এসব বিষয়ে অর্থ বিভাগ থেকে ইতিবাচক মনোভাব দেখানো হয়েছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন, ২৪ ঘণ্টার শিক্ষা চ্যানেল চালু, হাওর অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্ফ্মকালীন ছুটি পরিবর্তন, টিআর, কাবিখা কর্মসূচির শেষ কিস্তির বরাদ্দ মার্চ মাসের আগে মঞ্জুরির বিষয়গুলো ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
দিনাজপুরের ডিসি খালেদ মোহাম্মদ জাকী তাঁর প্রস্তাবে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) অধীনে একটি অধিদপ্তর স্থাপনসহ বিভাগীয় পর্যায়ে অফিস করার প্রস্তাব করেছেন। আইএমইডির দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, এমন একটি উদ্যোগ অনেক আগে থেকেই বাস্তবায়নের চিন্তা করছে সরকার। বর্তমানে দেশে ১৬০০-এর বেশি প্রকল্প সারাদেশে চলছে। এত প্রকল্প আইএমইডির পক্ষ থেকে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন সম্ভব না হওয়ায় বেসরকারি ফার্ম দিয়ে কাজ করানো হয়। এসব কাজের মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। এ কারণে শুধু বিভাগ নয়, জেলায় পর্যায় পর্যন্ত আইএমইডির অফিস নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা।
এ ছাড়া বিদ্যমান বিভিন্ন আইন-বিধির সংশোধন সংক্রান্ত একাধিক প্রস্তাব সম্পর্কে যথাযথ যাচাই-বাছাই শেষে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে ডিসিদের।
মন্তব্য করুন