নতুন বছরের শুরুতেই বিদ্যুতের দাম বাড়ে ৫ শতাংশ। এর পরপরই গ্যাসের দামও এক লাফে ৮২ শতাংশ বাড়ার ঘোষণা আসে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে নির্মাণ খাতের কাঁচামালের দাম উঠছে-নামছে, পাশাপাশি ডলার সংকটে কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা যাচ্ছে না চাহিদার অর্ধেকও। এ পটভূমিতে রড, সিমেন্ট, ইট, বালু, পাথর, টাইলসসহ প্রতিটি নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ছে। সব মিলিয়ে এ খাতে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা।

এদিকে নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক দাম বাড়ায় কমে যাচ্ছে পণ্যের চাহিদা। তাই কমে যাচ্ছে কারখানার উৎপাদনও। বহুমুখী সংকট মোকাবিলা করে নির্মাণ খাত সচল রাখতে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। নির্মাণসামগ্রীর দামে লাগাম না থাকায় বেড়ে যাচ্ছে আবাসন খাতের খরচ। বাড়ছে সরকারের বড় বড় প্রকল্পের ব্যয়ও। বারবার খরচ বাড়িয়েও প্রকল্পের ইতি টানতে পারছে না সরকার।

গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় ফেব্রুয়ারি থেকে রডের দাম আবার টনপ্রতি দেড় থেকে ২ হাজার টাকা বাড়বে বলে জানিয়েছেন ইস্পাত খাতের ব্যবসায়ীরা। প্রতি ব্যাগ সিমেন্টের দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা বাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। দাম বাড়ার মিছিলে আছে ইট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানও। ব্রিকস ফিল্ড মালিকরা বলছেন, প্রতি পিস ইটের দাম বাড়বে দুই থেকে তিন টাকা। পাথর, বালু ও টাইলসের দামও প্রতি ফুটে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্নিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

নির্মাণ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, শুধু গ্যাস কিংবা বিদ্যুৎ নয়; তাঁদের ভালোই ভোগাচ্ছে ডলার। কাঁচামাল আনতে চাহিদার অর্ধেক এলসিও করতে পারেনি বিএসআরএম, জিপিএইচ, এইচএম স্টিল, কেএসআরএমসহ রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সময়মতো এলসির টাকা পরিশোধ করতে না পারায় আমদানি কার্যাদেশও বাতিল করছে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। ডলার সংকট না কাটলে কাঁচামালের অভাবে উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন আমদানিকারকরা।

বিএসআরএম স্টিলের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, 'নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে রড উৎপাদনে টনপ্রতি খরচ ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে। রডের দাম বাড়লে সব ধরনের অবকাঠামো খরচও বাড়বে। বড় সংকট তৈরি করছে ডলার। এ কারণে ঋণপত্র খুলতে পারছেন না আমদানিকারকরা। কাঁচামাল না আসায় দেশে স্ট্ক্র্যাপের দামও বাড়ছে। সবার আগে এখন কাঁচামাল আমদানি স্বাভাবিক করাটা বেশি জরুরি।'

রড, সিমেন্ট ও পরিবেশবান্ধব ইট উৎপাদন করে মোস্তফা হাকিম গ্রুপ। এই গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ সরওয়ার আলম বলেন, 'কাঁচামাল আনতে পদে পদে বাধার মুখে পড়ছি। ডলার না থাকায় রডের কাঁচামাল আনতে চাহিদার অর্ধেক এলসিও খুলতে পারছে না ব্যাংক। সিমেন্ট খাত অনেক আগে থেকেই রয়েছে মুমুর্ষূ অবস্থায়। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে এখন আরও শোচনীয় হবে এ খাত। প্রতি ব্যাগ সিমেন্টের দাম ২০ থেকে ৩০ টাকা বাড়বে। ইটের দামও হাজারে অন্তত ২ থেকে তিন হাজার টাকা বেড়ে যাবে।'

দাম যত বাড়ছে, উৎপাদন তত কমছে: দেশে রডের বাজার ৫৫ হাজার কোটি টাকার। বড় ও মাঝারি আকারের রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট উৎপাদন সক্ষমতা ৯০ লাখ টন। এর মধ্যে চাহিদা ৪০ লাখ টনের মতো। তবে চলমান ডলার সংকটে কাঁচামাল আনতে না পারায় ইস্পাতের উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। দাম বাড়তে থাকায় কমেছে ক্রেতার চাহিদাও। এখন সব মিলিয়ে উৎপাদন হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ লাখ টন রড। এতে রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পড়ছে বিপাকে। কারখানা সচল রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন সিমেন্ট কারখানার মালিকরাও। পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে এরই মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। চালু থাকা ৩০ থেকে ৩৫টি সিমেন্ট কারখানার এখন মোট উৎপাদন ক্ষমতা সাড়ে ৪ কোটি টন। এক বছর ধরে দফায় দফায় দাম বেড়েছে সিমেন্টের। তাই কমছে ক্রেতার চাহিদাও। পাশাপাশি কমছে উৎপাদনও।

একই হাল ইট, বালু, টাইলস ও পাথর ব্যবসায়ীদেরও। উৎপাদন ব্যয় বাড়তে থাকায় তাঁদেরও এক বছর ধরে দফায় দফায় বাড়াতে হয়েছে দাম। এখন আবার গ্যাস ও বিদ্যুৎ নিয়ে এসেছে নতুন চিন্তা।

নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছিল ছয় মাস আগে: জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাবে ২০২২ সালের আগস্টে এক দফা দাম বেড়েছিল নির্মাণসামগ্রীর। তখন ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন ও পেট্রোলের দাম সর্বনিম্ন ৩৪ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪৬ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। আর তাতেই সিমেন্টের দাম বাড়ে প্রতি বস্তায় ৩০ থেকে ৪০ টাকা। ডলার সংকটও তখন প্রকট আকার ধারণ করেছিল। এজন্য কাঁচামাল আমদানিতে খরচ তখনই ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছিল। খুচরা পর্যায়ে তখন ৫০ কেজির প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম কোম্পানি ভেদে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৫২০ থেকে ৫৪০ টাকা। অথচ এক বছর আগেও কোম্পানি ভেদে প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম ছিল ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির (বিসিএমএ) সভাপতি মো. আলমগীর কবির সমকালকে বলেন, 'গত ৩০ বছরের মধ্যে সিমেন্ট খাত এমন ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়েনি। বিশ্ববাজারে কাঁচামাল, পণ্য পরিবহনে জাহাজ ভাড়া ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে বাড়তি জ্বালানি খরচ যোগ হয়ে ছয় মাস আগে দাম বাড়াতে হয় সিমেন্টের। এ জন্য ক্রেতার সংখ্যা হঠাৎ করে কমে যায়। এখন আবার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এবার কীভাবে এ খাত সংকট কাটাবে বুঝতে পারছি না।

কাঁচামাল মিলছে না চাহিদার অর্ধেকও: সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামালের শতভাগই আমদানিনির্ভর। সিমেন্ট তৈরিতে পাঁচ ধরনের কাঁচামাল ব্যবহার হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ কোটি ৩৫ লাখ টন সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানি হয়েছে। কাঁচামালের আমদানি কমলেও খরচ বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। আগের অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১৫৪ কোটি মার্কিন ডলারের কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে এই অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে সিমেন্টের প্রায় দেড় থেকে ২ কোটি টন কাঁচামাল আসার কথা। তবে এই অর্থবছরে কাঁচামাল এসেছে চাহিদার অর্ধেক। একই অবস্থা রড উৎপাদন খাতেও। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আনতে পারছে না তারাও। এইচএম স্টিলের পরিচালক মোহাম্মদ সরওয়ার আলম বলেন, 'প্রতি মাসে যে পরিমাণ কাঁচামালের এলসি খুলতে হয় তার মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশের টাকা জোগান দিতে পারছে ব্যাংক। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে।'

সুফল নিতে পারেনি বাংলাদেশ: বিশ্ববাজারে নির্মাণ উপকরণ তৈরির কাঁচামালের দাম আগের তুলনায় এখন কিছুটা কম। মে-জুনের তুলনায় কমেছে জাহাজ ভাড়াও। তবে ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এবং গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে পড়ে এ সুবিধা নিতে পারেননি দেশীয় উদ্যোক্তারা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত জুনে রডের কাঁচামালের আমদানি মূল্য ছিল টনপ্রতি ৫৯০ ডলার। এই দাম বিশ্ববাজারে কমেছে ধারাবাহিকভাবে। গত নভেম্বরে টনপ্রতি রডের কাঁচামালের আমদানি মূল্য নেমে আসে ৪৭০ ডলারে। ডিসেম্বরে আরও ৩০ থেকে ৪০ ডলার কম ছিল আমদানি দর। তবে এ সময়ে দেশে ডলারের সংকট ছিল চরমে। তাই বিশ্ববাজারে দাম কমার এ সুযোগ নিতে পারেননি দেশের ব্যবসায়ীরা। এ জন্য বাংলাদেশে উল্টো বেড়েছে রডের দাম।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, জুনে খুচরা বাজারে যে রডের দাম ছিল টনপ্রতি ৮৩ থেকে ৮৯ হাজার টাকা, সেটি ডিসেম্বরে হয়েছিল ৮০ থেকে সাড়ে ৯০ হাজার টাকা। এখন গ্যাস ও বিদ্যুতের কারণে রডের দাম আবার বাড়বে।

আবাসন খাতে অশনিসংকেত: আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের তথ্য বলছে, দুই বছরের ব্যবধানে ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের দাম প্রতি বর্গফুটে বেড়েছে ৫৪১ টাকা ৩৮ পয়সা। ২ হাজার ফুটের একটি স্থাপনাতে শুধু রডের দাম বাড়ার কারণে ফ্ল্যাটের প্রতি স্কয়ার ফুটে নির্মাণ খরচ বেড়েছে ১২০ টাকা। একইভাবে সিমেন্টের কারণে ৪৪ টাকা, বালুর কারণে ২৩ টাকা, ইটের কারণে ৪০ টাকা, পাথরের কারণে ৬৭ টাকা ৫০ পয়সা, থাই অ্যালুমিনিয়ামের কারণে ৩৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে খরচ।

রিহ্যাবের সহসভাপতি ও চট্টগ্রাম রিজিওনাল কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল কৈয়ূম চৌধুরী জানান, এভাবে খরচ বাড়তে থাকায় কমে গেছে ক্রেতা। এখন আবার নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়লে পরিস্থিতি সামাল দিতে তাঁদের বেগ পেতে হবে।