যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের ১০ বছরপূর্তি আজ। গত এক দশক ধরেই গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা ও তর্কবিতর্ক চলছে। রাজধানীর শাহবাগের এই আন্দোলনকে ঘিরে কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে। সব মিলিয়ে শাহবাগ আন্দোলন সফল না ব্যর্থ তা নিয়ে বিভিন্ন মহলের রয়েছে নানা মত।

সংগঠক ও অংশগ্রহণকারীরা বলছেন, যে দাবিতে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে, তা অনেকটাই পূরণ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হয়েছে। মৌলবাদী রাজনীতি নিষিদ্ধ না হলেও তাদের বিকশিত হওয়ার সুযোগ কমেছে।

বিশ্নেষকদের মতে, এই ঘটনা দেশে প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল দুটি বিপরীত ধারা জন্ম দিয়েছে, যাদের মধ্যে আগামীতে সংঘাত অনিবার্য। আবার বিরোধী রাজনীতিবিদদের অনেকেই মনে করেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সহায়তায় গড়ে ওঠা এই আন্দোলন তাদেরই (আওয়ামী লীগ) সহযোগিতা করেছে, জনগণের কোনো লাভ হয়নি। এ বিষয়ে ভিন্নমতও আছে। ফলে এই আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর পরই একদল তরুণ-তরুণী রাজধানীর শাহবাগে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরামের ব্যানারে জড়ো হয়ে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানায়। দ্রুতই বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যোগ দেন তাতে। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা শাহবাগেই টানা অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। সারাদেশে এমনকি বিশ্বের নানা প্রান্তে একাত্মতা জানিয়ে অনুরূপ কর্মসূচি পালিত হয়। আন্দোলনকারীদের দাবির মুখে সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আইন সংশোধন করে। সংশোধিত আইনে রাষ্ট্রপক্ষ কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে। বিচারে আদালত কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ দেন।

প্রায় একই সময়ে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ১৩ দফা দাবি নিয়ে মাঠে নামে। অনেকেই মনে করেন, শাহবাগ আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় হেফাজতে ইসলামের উত্থান। হেফাজতসহ তাদের সমমনা কিছু সংগঠন গণজাগরণ মঞ্চকে 'নাস্তিকদের আন্দোলন' হিসেবে প্রচার করে। কয়েকজন ব্লগারের লেখাকে নাস্তিকতার প্রচার হিসেবে দেখিয়ে কয়েকটি সংবাদপত্রে লেখা প্রকাশ করা হয়। এভাবে ধর্মের দোহাই দিয়ে শাহবাগ আন্দোলনকে বিতর্কিত করার চেষ্টা হয়।

আন্দোলনে প্রথম দিকের অংশগ্রহণকারীদের একজন আরিফ জেবতিক মনে করেন, শাহবাগ আন্দোলন যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির যে মূল দাবি নিয়ে সংগঠিত হয়েছিল, তাতে পুরোপুরি সফল হয়েছে। কিছু পারিপার্শ্বিক দাবি রয়েছে, যেগুলো আগামীতে বাস্তবায়িত হবে। তিনি বলেন, এ আন্দোলনের কারণে দেশের মৌলবাদীদের রাজনীতি করার সুযোগ কমেছে। এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় অব্যবহিত পরে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন ও কোটাবিরোধী আন্দোলনসহ প্রভৃতি গড়ে উঠেছে। ওই বছরের মে মাসে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের কয়েক দিনের লাগাতার অবস্থানকে জেবতিক মনে করেন, হেফাজতকে ব্যবহার করে কেউ কেউ শাহবাগ আন্দোলন ঠেকাতে চেয়েছিল।

তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী লাকী আক্তার সমকালকে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে যে লড়াই অব্যাহত ছিল, জাহানারা ইমাম যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তারই ধারাবাহিকতা হলো শাহবাগ আন্দোলন। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত হলেও শাহবাগ আন্দোলন সমাজে বৃহত্তর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার যে প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছিল, তা বাস্তবায়ন করতে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, ব্লগার হত্যার মতো জঘন্য অপরাধের বিচার আজও মেলেনি।

লাকী মনে করেন, শাহবাগ আন্দোলন এ দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের ছাপ রেখে গেছে। যেমন নারীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, গণজাগরণ মঞ্চকে ঠেকাতে সব পক্ষেই নানা সমীকরণ ছিল, হেফাজতকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়েছিল। আমাদের দেশে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে আগামীতেও এ রকম বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে উঠবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস বিশ্নেষণ করে বলেন, শাহবাগ আন্দোলন দেশে দুটি ধারা সৃষ্টি করেছে। গণজাগরণ মঞ্চ ও শাপলা চত্বর দুটিতেই অংশগ্রহণকারীদের ৮০ শতাংশই তরুণ। এদের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য। যারা জয়ী হবে, তাদের হাতেই গঠিত হবে আগামীর বাংলাদেশ।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল মনে করেন, আওয়ামী লীগ নিজেদের স্বার্থ হাসিলে কিছু লোককে সামনে রেখে গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে তুলেছিল। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এ আন্দোলনে জনগণের তেমন লাভ হয়নি।

তবে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী আরিফ জেবতিক মনে করেন, এ আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ম্ফূর্ত। এখানে নানা মতের, নানা পেশার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে। এখানে কোনো রাজনৈতিক দলের স্বার্থ হাসিলের বিষয় ছিল না।