- সারাদেশ
- ঋণের টাকায় রাজনীতি, শেষ পর্যন্ত ভরাডুবি
ঋণের টাকায় রাজনীতি, শেষ পর্যন্ত ভরাডুবি

ব্যাংক ঋণ নিয়ে সঠিক ব্যবহার না করায় চট্টগ্রামে প্রভাবশালী অনেক ব্যবসায়ী নিঃস্ব হয়েছেন। কেউ কেউ রাজনীতির মোহে পড়ে ঋণের টাকা উড়িয়েছেন। কেউ কেউ ঋণ নিয়ে রাতারাতি ব্যবসা বাড়াতে জড়িয়েছেন রাজনীতিতে। লোভের কারণে শেষ পর্যন্ত পারিবারিক ব্যবসার ঐতিহ্য ও রাজনীতিতে সম্মান হারিয়েছেন তাঁরা। আলোচিত এমন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা কারাগারে আছেন কিংবা অনেকে মামলা মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ব্যাংক কর্মকর্তাদের এড়িয়ে চলতে খুব কাছের মানুষ ছাড়া কারও ফোনও রিসিভ করেন না তাঁরা। যাঁরা কারাগারের বাইরে আছেন, তাঁরা নিজস্ব কার্যালয়েও বসেন না।
খাতুনগঞ্জের একসময়কার বনেদি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইলিয়াস ব্রাদার্স। ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা রাজনীতিতে দেদার খরচ করে প্রতিষ্ঠানের মালিকরা শেষ পর্যন্ত সুনাম ধরে রাখতে পারেননি। ঋণের টাকা রাজনীতিতে ঢেলে 'নিঃস্ব' হয়েছেন রাইজিং গ্রুপের আসলাম চৌধুরীও। বলা হয়, এমপি হওয়ার মোহে হঠাৎ রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। এখন তিনি কারাগারে। আবার রাজনীতিতে জড়িয়ে ব্যাংক ঋণের ফাঁদ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেননি জাতীয় পার্টির সংরক্ষতি আসনের এমপি মাহজাবীন মোরশেদ। তাঁর স্বামী মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহীমও হয়েছেন মামলার আসামি। অথচ মোরশেদ ঐতিহ্যবাহী চিটাগং চেম্বারের সাবেক সভাপতি।
রাজনীতিতে এসে বনেদি প্রতিষ্ঠান ডুবালেন শামসুল আলম :দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ভাইয়ের সঙ্গে 'ইলিয়াস ব্রাদার্স' নিয়ে যাত্রা শুরু করেন মো. ইলিয়াস। ভোগ্যপণ্য নিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও পরে একে একে যুক্ত হয় জিপি-সিআই শিট, গ্লাস শিট, সয়াবিন তেল, কাগজ ও বোর্ড, তৈরি পোশাক এবং ব্রিকস ফিল্ডের ব্যবসা। সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে তাঁদের 'দাদা' ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল ও মিনারেল ওয়াটার। কিন্তু ইলিয়াসের সেই অর্জন ধরে রাখতে পারেননি তাঁর ছেলে নুরুল আবসার ও শামসুল আলম। ব্যবসা রেখে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন শামসুল আলম। প্রভাব খাটিয়ে বিএনপির আমলে দু'হাত ভরে ঋণও নিতে থাকেন ব্যাংক থেকে। অনেকেই বলেন, পদ বাগাতে সেই ঋণের টাকা খরচ করেছেন রাজনীতিতে। ভেবেছিলেন এমপি হয়ে ব্যাংককে বশে আনতে পারবেন। কিন্তু সেই আশা আর পূরণ হলো না শামসুল আলমের। এখন তিনি কারাগারে। ভরাডুবি হয়েছে তাঁদের পারিবারিক ব্যবসারও। শিল্প গ্রুপ ইলিয়াস ব্রাদার্স এখন দেশের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির একটি। বিভিন্ন ব্যাংকে গ্রুপের খেলাপি ঋণ প্রায় হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৮৩ কোটি টাকা খেলাপির দায়ে শামসুল আলমসহ গ্রুপের পাঁচ পরিচালককে পাঁচ মাসের সাজা দিয়েছেন আদালত। আবার সাউথইস্ট ব্যাংকে ৮৫ কোটি ৫৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকা খেলাপির দায়ে পাঁচ পরিচালককে পাঁচ মাসের সাজা দিয়েছেন আদালত। দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামসুল আলম, চেয়ারম্যান নুরুল আবসার, পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আলম, শামসুল আলমের স্ত্রী ও পরিচালক কামরুন নাহার বেগম, নুরুল আবসারের স্ত্রী ও পরিচালক তাহমিনা বেগম। অর্থঋণ আদালতে আরও অর্ধশত মামলায় তাঁদের বিরুদ্ধে আছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। অগ্রণী ব্যাংকে ২৮০ কোটি, ইস্টার্ন ব্যাংকে ৭৩, ইসলামী ব্যাংকে ৬৩, এবি ব্যাংকে ৬২, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ৫৫, সিটি ব্যাংকে ৫৫, ব্যাংক এশিয়ায় ৩৯, ওয়ান ব্যাংকে ৩০ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ২৪, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকে ১৮, পূবালী ব্যাংকে ৭ কোটি এবং এক্সিম ব্যাংকে খেলাপি ঋণ তাঁদের ৪ কোটি টাকা।
ঋণের টাকা রাজনীতিতে ঢেলে কারাগারে আসলাম চৌধুরী :বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আসলাম চৌধুরী কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষকতার মাধ্যমে। এক পর্যায়ে শিক্ষকতা ছেড়ে যোগ দেন কবির স্টিল মিল কোম্পানিতে। কনফিডেন্স সিমেন্ট কোম্পানির হিসাব বিভাগের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। পরে কনফিডেন্স সল্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শুরু করেন ব্যবসা। এ ব্যবসাই তাঁকে টেনে আনে রাজনীতিতে। ছাত্রজীবনে রাজনীতিতে জড়িত না থাকলেও বিএনপির আমলে যুক্ত হন রাজনীতিতে। ২০০২ সালে তিনি হন জিয়া পরিষদের চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক। এই পদের প্রভাব খাটিয়েই ঋণের জগতে হাতেখড়ি আসলাম চৌধুরীর। ব্যাংকের টাকায় রাতারাতি গড়ে তোলেন রাইজিং গ্রুপ। গড়ে তোলেন এক ডজন শিল্প প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সম্পদের তুলনায় ঋণ নিয়েছেন তিনি পাঁচ গুণ বেশি। তিনি এখন ৮০টিরও বেশি মামলার আসামি। কারাগারে আছেন সাত বছর ধরে।
২০০৭ সালে বিএনপির রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত হন আসলাম চৌধুরী। সংগঠনের প্রয়োজনে টাকা ঢালতে থাকেন অকাতরে। অনেক নেতাকে পেছনে ফেলে তিনি হয়ে যান উত্তর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সীতাকুণ্ড আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নও পান। তবে হেরে যান আওয়ামী লীগের আবুল কাসেম মাস্টারের কাছে। পরে দায়িত্ব পান কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদকের। ২০১৪ সালে জেলা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে পেছনে ফেলে বাগিয়ে নেন উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়কের পদটিও। এর পর হয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিবও। মোসাদকাণ্ডে (ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা) জড়িয়ে আসামি হয়েছেন রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার। সপরিবারে আসামি হয়েছেন দুদকের মামলায়ও। এবি ব্যাংকের সোয়া ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় আসলাম চৌধুরীসহ তাঁর পরিবারের চারজনের বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক তাঁদের বিরুদ্ধে করেছে অর্ধশত মামলা। এক ডজনের বেশি রাজনৈতিক মামলাও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। শীর্ষ ঋণখেলাপি হওয়া ২০ জনের তালিকায়ও নাম এসেছে তাঁর।
আসলাম চৌধুরীর এমন পরিণতিতে হতাশা ব্যক্ত করে ফেসবুকে আবেগঘন এক স্ট্যাটাস দিয়েছেন তাঁর মেয়ে মেহরীন আনহার উজমা। তিনি লিখেন, 'পাঁচটি বছর পরেও ফিরে পাইনি তোমাকে। বাবা, রাজনীতির প্রয়োজন নেই, আমাদের কাছে ফিরে এসো। তোমার প্রতীক্ষায় আছি আমি আর মা।' উজমা আরও লিখেছেন, 'বাবা তুমি প্রয়োজনে রাজনীতি থেকে সাময়িক অবসর নাও। চূড়ান্ত অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত একান্ত তোমার। তবুও তুমি এ সময়ে আমার পাশে, আমার কাছে ফিরে আসো। তোমাকে আমার আর মায়ের অনেক বেশি প্রয়োজন।' ২০২১ সালে জন্মদিনে আসলাম চৌধুরীর মেয়ে ফেসবুকে এই স্ট্যাটাস দেন।
শেষ রক্ষা হলো না মোরশেদ মুরাদ ও তাঁর স্ত্রীর: মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম ঐতিহ্যবাহী চিটাগাং চেম্বারের সাবেক সভাপতি। হঠাৎ যুক্ত হন তিনি জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে। পেয়ে যান জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যানের পদও। স্ত্রী মাহজাবীন মোরশেদকেও আনেন রাজনীতিতে। পরপর দু'বার জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টি থেকে সংরক্ষিত আসনের এমপিও হন তাঁর স্ত্রী। এর মধ্যেই অন্য জগতে সক্রিয় হতে থাকেন মোরশেদ মুরাদ। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ক্রিস্টাল গ্রুপকে বড় করতে থাকেন তিনি। ফিশিং, শিপিং, স্টিল ও বিবিধ খাতের নামে নিতে থাকেন ব্যাংক ঋণ। কিন্তু সেই ঋণের টাকা পরিশোধ না করে রাজনীতির প্রভাব খাটাতে থাকেন স্বামী-স্ত্রী দু'জনই। অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি কারোরই। বেসিক ব্যাংক থেকে নেওয়া ২৭৫ কোটি টাকা ঋণ আত্মসাতের অভিযোগে ক্রিস্টাল গ্রুপের কর্ণধার মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম ও তাঁর স্ত্রী মাহজাবীন মোরশেদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ১৩৪ কোটি টাকা ঋণ নিতে ব্যাংক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে মাত্র ১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা মূল্যের জমি বন্ধক ও ১ কোটি টাকার এফডিআর লিয়েনে রাখেন মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহীম। পর্যাপ্ত পরিমাণ সহায়ক জামানত ছাড়াই এ ঋণ দেওয়ায় মামলাতে আসামি করা হয়েছে বেসিক ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম সাজেদুর রহমানকেও। এদিকে মাহজাবীন মোরশেদকে আসামি করা হয়েছে ১৪১ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায়। আইজি নেভিগেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ওই ঋণের জন্য আবেদন করেছিলেন মাহজাবীন মোরশেদ। প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নিয়েছেন তিনি। এ মামলায় অন্য দুই আসামি হলেন- আইজি নেভিগেশন লিমিটেডের পরিচালক সৈয়দ মোজাফফর হোসেন ও বেসিক ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলাম। এ দুটি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও আটটি অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহীমের হাজার কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। এসব টাকা পরিশোধ করতে না পেরে তাঁরা চলে গেছেন বিদেশে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রিস্টাল গ্রুপের অনুকূলে বিভিন্ন সময় অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের তথ্য উদ্ঘাটন করে। 'রয়েল ডিপ সি ফিশিং' প্রতিষ্ঠানের নামে ফারমার্স ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা হতে ঋণ নিতে এবিএম মঞ্জুরুল আলম নামে প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মচারীকে মালিক দেখান তাঁরা। আরেক কর্মচারী মিফতাউল আমানকে চিটাগাং ফিশারিজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক দেখিয়ে ২৮ কোটি টাকা ঋণ নেন তাঁরা ফারমার্স ব্যাংকের মতিঝিল শাখা থেকে। রূপালী ব্যাংকেও 'ক্রিস্টাল শিপ ব্রেকার্স' এর ৫২ কোটি টাকা ঋণখেলাপি হয়েছে। এ ব্যাংক চেক প্রতারণার দুটি মামলা করেছে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে। এভাবে ব্যাংকের টাকা নয়ছয় করায় রাজনীতিতেও সম্মান হারিয়েছেন মোরশেদ মুরাদ ও তাঁর স্ত্রী।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চিটাগাং চেম্বারের বর্তমান সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ব্যাংক ঋণের ফাঁদে পড়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে গেছেন। কেউ কেউ লোভে পড়ে ব্যাংকের ঋণ নয়ছয় করেছেন। এটি ঢাকতে কেউ কেউ সক্রিয় হয়েছিলেন রাজনীতিতেও। কিন্তু সত্যকে ঢাকতে পারেনি কোনোটিই।
মন্তব্য করুন