চলতি শীত মৌসুমে নোয়াখালীতে শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়ার প্রকোপ দেখা গেছে। গত দুই মাসে (ডিসেম্বর ও জানুয়ারি) জেলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ৩০০ শিশু। তাদের মধ্যে যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে ১০০ শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। স্বজনের দাবি, হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি। মেঝেতে রাখতে হচ্ছে। এর ওপর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা নিয়মিত আসেন না। ইন্টার্ন চিকিৎসক ও নার্সরা ঠিকমতো রোগী দেখেন না। চিকিৎসার অভাবে প্রাণহানি বেড়েছে।

দুই মাসে ১০০ শিশুর মৃত্যুর কথা স্বীকার করে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, মৃতদের বেশিরভাগের বয়স শূন্য থেকে ২৮ দিন। তারা স্পেশাল কেয়ার নিউনেটাল ইউনিটে মারা গেছে। নির্দিষ্ট সূচি মেনে মেডিকেল অফিসার, কনসালট্যান্ট ও সহকারী অধ্যাপকরা দায়িত্ব পালন করেন। অনিয়মিত হওয়ার সুযোগ নেই। এর পরও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, অর্ধেক জনবল দিয়ে চলছে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল। এ জন্য পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ কিছু বিষয়ে ঝামেলা হয়। আউটডোর ও ইনডোর মিলে দিনে গড়ে ২ হাজার রোগী চিকিৎসা নেন। ফলে চিকিৎসা ও ওষুধ দিতে হিমশিম খেতে হয়।

গত শনিবার সরেজমিন হাসপাতালের তিনটি শিশু ওয়ার্ড ঘুরে রোগীর স্বজন ও দায়িত্বরতদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, এখানে মোট শয্যা ৩৯টি। অথচ সব সময় দুই শতাধিক রোগী ভর্তি থাকেন। এর মধ্যে দারিদ্র্যপীড়িত জেলার উপকূলীয় হাতিয়া, সুবর্ণচর, কবিরহাট ও কোম্পানীগঞ্জের রোগী বেশি। সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয় সংশ্নিষ্টদের। বিশেষজ্ঞরা নিয়মিত রোগী না দেখায় স্বজনদের নোয়াখালী আবদুল মালেক উকিল সরকারি মেডিকেল কলেজ ও চিকিৎসক সহকারী প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ের (ম্যাটস) ইন্টার্ন চিকিৎসক-নার্সদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।

হাসপাতালের ৪ নম্বর শিশু ওয়ার্ডের ইনচার্জ আকলিমা আক্তার জানান, ডিসেম্বরে তাঁর ওয়ার্ডে ৩৪১ শিশু নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে মারা গেছে ১৮ জন। জানুয়ারিতে ভর্তি ৩৫ শিশুর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের। ১৩ নম্বর শিশু ওয়ার্ডের ইনচার্জ কামাল উদ্দিন ব্রাদার জানান, ডিসেম্বরে তাঁর ওয়ার্ডে ৪০০ শিশু নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে ১১ জন মারা গেছে। জানুয়ারিতে ভর্তি ৩৮৪ শিশুর মধ্যে মারা গেছে ১৩ জন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের স্পেশাল কেয়ার নিউনেটাল ইউনিট (স্কেনু) ওয়ার্ডের জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স জানান, ডিসেম্বরে এ ওয়ার্ডে ৬৩ শিশু নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি হয়, মারা যায় ২১ জন। জানুয়ারিতে ৫১ শিশুর মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রাণ হারায় ২২ জন। মৃতদের মধ্যে ৩১ জন নির্ধারিত সময় বা ৩৭ সপ্তাহের আগে জন্মগ্রহণ করে।

শিশু ওয়ার্ডের ইনচার্জ কামাল উদ্দিন জানান, দিনে গড়ে ওয়ার্ডে ৪০-৫০ শিশু নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। এত সংখ্যক রোগী সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা। হাসপাতালে বিভিন্ন প্রকার অ্যান্টিবায়োটিক ও বমির ইনজেকশনের সংকট রয়েছে। শিশুদের বুকের কফ পরিস্কারের নেবুলাইজার মেশিন থাকলেও নেই ওষুধ। সময়মতো কফ পরিস্কার না করায় জটিলতা বাড়ছে।

হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) সৈয়দ মহি উদ্দিন আবদুল আজিম বলেন, ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে শীতের তীব্রতা বেশি থাকায় শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়। এ সময় অভিভাবকদের বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে।

হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ইয়াকুব আলী মুন্সি বলেন, বাড়িতে আনাড়ি ধাত্রীর মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের আগে অথবা পরে প্রসবজনিত কারণে প্রসূতি ও নবজাতক আহত হচ্ছে। শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে আনায় চিকিৎসকদের কিছুই করার থাকছে না। শিশুকে নিউমোনিয়া থেকে সুরক্ষায় অভিভাবদের সচেতন হতে হবে। ঠান্ডা লাগতে দেওয়া যাবে না। নাক বন্ধের আগেই পরিস্কার করে দিতে হবে। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি, বুকের নিচের অংশ অতিরিক্ত ওঠানামা ও খাওয়া বন্ধ করে দিলে দ্রুত শিশুকে হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।