চর্যাপদে নিজের ষষ্ঠ পদে ভুসুকুপা লিখেছিলেন- 'আপনা মাঁসেঁ হরিণা বৈরী'। সুস্বাদু মাংসের কারণে হরিণের অসহায়ত্ব তুলে ধরেছিলেন কবি। হাজারো বছর পেরিয়েও ভুসুকুপার রচনার অর্থ বদলায়নি একটুও। সুন্দরবনের ভেতর হরিণ শিকার থামেনি। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় একশ্রেণির শিকারি তৃণভোজী প্রাণীটি বধ করেই যাচ্ছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৌশল বদলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে মাছ ধরার পাস নিয়ে বনে ঢুকে হরিণ শিকারে মেতেছে একশ্রেণির শিকারি। আবার চোরাশিকারির অনেকেই অবৈধভাবে বনে অনুপ্রবেশ করছে শিকারের জন্য। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এদের কঠোর শাস্তির দাবি করেছেন পরিবেশবাদী নেতারা।

সুন্দরবনসংলগ্ন লোকালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হরিণ শিকার নিষিদ্ধ হলেও একশ্রেণির মানুষের লোভের কারণে তা দিন দিন বাড়ছে। শীত মৌসুমে হরিণ শিকার বেড়ে যায় কয়েক গুণ। কৌশলে শিকারের পর মাংস ছাড়াও চামড়া শুকিয়ে বিক্রি করে সংঘবদ্ধ চক্র। এর পেছনে রয়েছেন জনপ্রতিনিধি এবং ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতারা। যে কারণে বনরক্ষী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে কিছুদিন পরপর শিকারিরা ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে আসে। আবারও মেতে ওঠে হরিণ নিধনে।

গত তিন সপ্তাহে শিকারিদের হাত থেকে প্রায় ১০০ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করা হয়েছে। এ সময় চারটি চামড়া, হরিণ ধরার ফাঁদ, ২০ রাউন্ড গুলি, একটি ট্রলার ও একটি নৌকা আটক করেন বনরক্ষীরা। তাঁরা ১০ শিকারিকে আটক করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতেও পাঠিয়েছেন।

বন বিভাগ সূত্র জানায়, গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে চাঁদপাই রেঞ্জের বৈদ্যমারী বাঁশতলায় একটি নৌকা থেকে ২০ কেজি হরিণের মাংস এবং ফাঁদ জব্দ করা হয়। এ সময় চার শিকারি পালিয়ে যায়। ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে সাতক্ষীরা রেঞ্জের তেরকাটি খালে পরিত্যক্ত অবস্থায় ৩০ কেজি মাংস উদ্ধার করেন বনরক্ষীরা। এর আগে ২৭ জানুয়ারি দুবলার জামতলা ও আলোরকোল থেকে মাংস ও ফাঁদসহ পাঁচ হরিণ শিকারিকে আটক করা হয়। ২৫ জানুয়ারি নীলকমল এলাকায় ২০ কেজি মাংস ও ২০ রাউন্ড গুলিসহ পাথরঘাটার শিকারি হিরো আকন আটক হয়। ২৩ জানুয়ারি শরণখোলার খুড়িয়াখালী গ্রামের তানজের আলীর বাড়ি থেকে দুটি হরিণের চামড়া উদ্ধার করেন বনরক্ষীরা। ২২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় কচিখালীর ডিমের চর থেকে একটি ট্রলারে পাওয়া যায় ১৫ কেজি মাংস। এ সময় দু'জনকে আটক ও ট্রলার জব্দ করা হয়।

স্থানীয়রা বলছেন, প্রতি কেজি হরিণের মাংস ৮০০ থেকে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হয়। বিপুল পরিমাণ অর্থের লোভে অনেকে মাছ শিকারের নাম করে সুন্দরবনে যাওয়ার পাস সংগ্রহ করে। পরে গভীর বনের সুবিধাজনক স্থানে নাইলনের সুতার তৈরি ফাঁদ পাতে তারা। এতে ধরা পড়া হরিণ জবাই করে মাংস ও চামড়া মাছের পেটিতে বরফ দিয়ে সংরক্ষণ করে। পরে সুবিধাজনক সময় লোকালয়ে পাচার করে আসছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, মাছ শিকারের নামে পাস নেওয়া শিকারিদের মধ্যে বাগেরহাটের মোংলার জয়মনী, চিলা, বৈদ্যমারী, শরণখোলার সোনাতলা, পানিরঘাট, রাজাপুর, রসুলপুর, মোড়েলগঞ্জের জিউধরা, বরগুনার পাথরঘাটার চরদুয়ানী, জ্ঞানপাড়া, খুলনার দাকোপের বানীশান্তা, ঢাংমারীসহ আশপাশের বেশ কিছু জনপদের লোকজন বেশি। তারা জেলের ছদ্মবেশে সুপতি, দুবলা, কটকা, কচিখালী, বাদামতলা, চান্দেশ্বর, টিয়ারচর, কোকিলমুনি, আন্ধারমানিকসহ গহিন সুন্দরবনের নানা অংশে হরিণ শিকার করে।

কয়েকজন জেলের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয় সমকালের। তবে নিরাপত্তার জন্য তাঁরা নাম প্রকাশে রাজি হননি। তাঁদের দেওয়া তথ্যমতে, সুন্দরবনের ভেতর কাঁকড়া শিকারের টোপ বানাতেও একশ্রেণির জেলে হরিণের মাংস ব্যবহার করছেন। তাঁরা বনে অবস্থানের সময় কৌশলে হরিণ শিকার করেন। পরে মাংস টোপ হিসেবে বড়শিতে গেঁথে কাঁকড়া শিকার করেন। ওই জেলেদের ধারণা, হরিণের মাংসের টোপে নদী ও খালে কাঁকড়া শিকার সহজ। বাগেরহাটের মোংলা ও রামপাল এবং সাতক্ষীরায় এমন প্রবণতা বেশি বলে জানিয়েছেন তাঁরা।

সাম্প্রতিক সময়ে হরিণ শিকারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) মোংলার সমন্বয়কারী শেখ মো. নূর আলম। তিনি বলেন, সুন্দরবনের হরিণ শিকারি চক্রের বেপরোয়া হয়ে ওঠার পেছনে প্রভাবশালীদের হাত রয়েছে। আর শিকারে জড়িতদের বেশিরভাগই বনসংলগ্ন এলাকার লোকজন। এভাবে নিধন চললে বনের জীববৈচিত্র্য ঝুঁকিতে পড়বে বলে মনে করেন তিনি। এ জন্য বনরক্ষীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে নূর আলম বলেন, এ বিষয়ে জনসাধারণকেও সচেতন হতে হবে।

বন বিভাগের পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, নিয়মিত টহল বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে হরিণ শিকারিরা আটক হচ্ছে। তাদের ধরতে টহল আরও জোরদার করা হবে।