- সারাদেশ
- ওদের মনের আলোয় হার মেনেছে চোখের অন্ধকার
চট্টগ্রামে এইচএসসিতে ভালো ফল ৮ অদম্য পরীক্ষার্থীর
ওদের মনের আলোয় হার মেনেছে চোখের অন্ধকার

তাঁদের কারও চোখেই নেই আলো। স্বাভাবিক মানুষের মতো নয় চারপাশ। শারীরিক সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি পরিবারের অসচ্ছলতা, নানা সংকট নিত্যসঙ্গী। টাকার অভাবে কেউ কেউ কিনতে পারেননি শিক্ষাসামগ্রী। তবে এসবের কিছুই তাঁদের সামনে বাধা হতে পারেনি। চোখে আলো না থাকলেও মনের আলোয় সকল প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়ে জয়ী হয়েছেন আট অদম্য পরীক্ষার্থী। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করেছেন তাঁরা।
পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে তাঁরা চালিয়ে গেছেন অন্যরকম যুদ্ধ। পড়ালেখার টাকার জন্য করেছেন টিউশনি। শ্রুতিলেখকের ওপর নির্ভর করে পরীক্ষায় বসতে হয় তাঁদের। এই আটজনের এমন অর্জনে দারুণ খুশি শিক্ষক, মা-বাবাসহ বোর্ডের সংশ্নিষ্টরা। তাঁদের কেউ হতে চান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, কেউ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিতে চান উচ্চতর ডিগ্রি, কেউবা হতে চান শিক্ষক, সমাজসেবক।
অদম্য ৮ জনের মধ্যে মোহাম্মদ সোহেল রানা অর্জন করেছেন জিপিএ ৫। এছাড়াও মোহাম্মদ তুষার জিপিএ ৪ দশমিক ৯২, মোহাম্মদ ফরিদ ৪ দশমিক ৮৩, মোহাম্মদ সাদেক ৪ দশমিক ৭৫, নয়নতারা ৪ দশমিক ৬৭, মোহাম্মদ রাসেল মিয়া ৪ দশমিক ৫০, তাসমিন আক্তার সুইটি ৪ দশমিক ৩৩ এবং আসমাউল হুসনা ৩ দশমিক ৯২ অর্জন করেছেন। সবার হাতেখড়ি হয় চট্টগ্রাম নগরের সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে। মানবিক বিভাগ থেকে নগরের সরকারি সিটি কলেজ, হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজ এবং আশেকানে আউলিয়া ডিগ্রি কলেজ থেকে এবারের পরীক্ষায় অংশ নেন তাঁরা।
রাসেল মিয়ার বাড়ি কিশোরগঞ্জে কুলিয়ারচরের ফরিদপুর ইউনিয়নে। তাঁর বাবা আঙ্গুর মিয়া কৃষক। তাঁরা তিন ভাই, দুই বোন। অন্য ভাইবোনেরা স্বাভাবিক হলেও রাসেলের দুই চোখে জন্ম থেকেই নেই আলো। বাবার সামান্য টাকা দিয়ে সংসার চলে না ঠিকভাবে। ধারদেনা করে রাসেলের ছোট ভাই শাকিল মিয়াকে কয়েক বছর আগে পাঠানো হয়েছে মালয়েশিয়ায়।
রাসেলের পড়ালেখার খরচ জোগাতেন ছোট ভাই। রাসেল সমকালকে বলেন, 'কৃষি কাজ করে সামান্য আয়ে পরিবার চালাতে বাবাকে হিমশিম খেতে হয়। পড়ালেখা চালিয়ে নিতে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতো। তবে ছোট ভাই সবসময় সাহস দিত; আর্থিকভাবেও করত সহযোগিতা। এইচএসসিতে ভালো ফল করায় খুশি সবাই।'
জন্মের পর থেকেই দুই চোখে সমস্যা সোহেল রানার। ডান চোখে সামান্য দেখলেও ক্রিকেট বলের আঘাতে একসময়ে তা নিভে যায়। এ কারণে তাঁকে পড়ালেখা না করাতে বলেন অনেকে। তিন ভাইবোনের মধ্যে কেবল সোহেলই প্রতিবন্ধী। সকল বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে এইচএসসিতে জিপিএ ৫ অর্জন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। তাঁর বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত।
অদম্য সোহেল বলেন, 'পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়া আমার জন্য অনেক কঠিন ছিল। অনেকে নানাভাবে কটূক্তি করত। কিন্তু কিছুতেই হারতে চাইনি। চালিয়ে গেছি অধ্যবসায়। দৃষ্টিহীনরাও সব পারে-এটি প্রমাণ করতে পেরে অন্যরকম ভালো লাগছে। অনেক খুশি হয়েছেন মা-বাবাসহ পরিবারের সবাই।'
তাসমীন আক্তার সুইটি ও আসমাউল হুসনা আপন বোন। তাঁরা চার বোনের তিনজনই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তবে জীবনে জয়ী তিনজনই। বড় বোন বিএ অধ্যয়নরত। ছোটবেলায় বাবাকে হারান তাঁরা। চাচা ও মামার আর্থিক সহায়তায় বেড়ে ওঠেন। বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায়। তবে নগরের হামজারবাগের বালিকা হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা করছেন সুইটি ও হুসনা।
নয়নতারা ও মোহাম্মদ ফরিদ সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। তাঁদের আছে দুই বছরের এক ছেলে। সংসার চলে দু'জনের বড় ভাইদের অর্থে। বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হয় তাঁদের।
এই দৃষ্টিহীনদের উৎসাহ, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন ও সাহস জুগিয়েছেন সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক আবদুস সামাদ। ৮ জনই জানিয়েছেন 'সামাদ স্যার' পাশে না থাকলে পথ পাড়ি দেওয়া কঠিন হতো।
এ প্রসঙ্গে আবদুস সামাদ সমকালকে বলেন, 'আটজনের জীবনই অনেক দুঃখ-কষ্টের। অনেক বাধা ডিঙিয়ে তারা ভালো ফল করায় আমি আনন্দিত। সব সময় তাদের সাহস দিতাম, আর্থিকসহ নানাভাবে সহায়তা করার চেষ্টা করতাম। তাদের সহায়তায় সরকারসহ সবারই এগিয়ে আসা উচিত।' চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ বলেন, স্বাভাবিক অনেক শিক্ষার্থী সকল সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পরও ফেল করেছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়েও অনন্য ফল করেছে আটজন। তাদের অর্জন অন্যদের উৎসাহ জোগাবে।
মন্তব্য করুন