শহিদুল মৃধা বেশ অবস্থাপন্ন কৃষক। বাড়ি রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার সাহেবপাড়া বেরুলি গ্রামে। অথচ তাঁর নাম রয়েছে নবাবপুর ইউনিয়নের একটি কর্মসৃজন প্রকল্পে শ্রমিকের তালিকায়। বিষয়টিতে বিস্মিত তাঁর কলেজপড়ূয়া মেয়ে তাহমিনা। গত রোববার বাড়িতে গেলে শহিদুল মৃধাকে পাওয়া যায়নি। তখন তাহমিনা জানান, তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে পড়ছেন। বাবা বয়োবৃদ্ধ হওয়ায় তেমন কাজকর্ম করতে পারেন না। মোবাইল ফোনও ব্যবহার করেন না।
অথচ তাঁর নাম ও একটি মোবাইল ফোন নম্বর পাওয়া গেছে সোনাইকুড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়সংলগ্ন ডোবা ভরাটের জন্য দেওয়া শ্রমিকের তালিকায়। যে ফোন নম্বরটি দেওয়া হয়েছে সেটিসহ বন্ধ পাওয়া গেছে ওই তালিকায় ৫০ জন শ্রমিকের নামের পাশে দেওয়া সবক'টি নম্বরই।

বালিয়াকান্দি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসূচির আওতায় (প্রথম পর্যায়) উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নে ৪০ দিনের কর্মসূচিতে চারটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এর একটি সোনাইকুড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়সংলগ্ন ডোবা ভরাটের কাজ। এ ছাড়া একই ইউনিয়নের জিয়েলগাড়ী বড় মসজিদ থেকে মীরবাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার (৩১ জন শ্রমিক), বড় হিজলী হাসুর বাড়ি থেকে সেকেনের বাড়ি পর্যন্ত মাটির রাস্তা সংস্কার ও বড়গরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ইমারতের বাড়ির পর্যন্ত মাটির রাস্তা সংস্কার (৬০ জন শ্রমিক); বলদা খাল ইউসুফের দোকান থেকে লাতুর বাড়ি পর্যন্ত মাটির রাস্তা সংস্কারে (৪০ জন শ্রমিক) প্রকল্প রয়েছে। সব মিলিয়ে চারটি প্রকল্পের তালিকায় ১৮১ জন শ্রমিকের নাম রয়েছে। তাঁদের ৪০০ টাকা করে দৈনিক মজুরি দেওয়ার কথা। ইতোমধ্যে তাঁদের মজুরি বাবদ প্রথম কিস্তির টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।

সোনাইকুড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়সংলগ্ন ডোবা ভরাটের কাজে ৫০ জন শ্রমিকের জন্য বরাদ্দ ছিল আট লাখ টাকা। সেটি পড়েছে ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে। রোববার দুপুর ১টার দিকে প্রকল্পের স্থানে গিয়ে দেখা যায়, বেশ বড় ডোবাটির কিছু অংশে এক্সক্যাভেটর দিয়ে আঁঠালো মাটি ফেলা হয়েছে। সেখানে কয়েকজন দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করছিলেন। এখানে কারা কাজ করছেন জানতে চাইলে এক ব্যক্তিকে দেখিয়ে দেন। টিপু নামের ওই ব্যক্তি বলেন, তিন দিন ধরে এক্সক্যাভেটর দিয়ে সেখানে মাটি ফেলছেন। স্থানীয় ইউপি সদস্যের নির্দেশনায় এ কাজ করছেন। এর বেশি কিছু জানেন না। ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবু তালেব মোবাইল ফোনে এ বিষয়ে বলেন, 'আমি কিছু জানি না। চেয়ারম্যান বলতে পারবেন।'

প্রকল্পটির তালিকায় যে ৫০ শ্রমিকের নাম আছে, তাঁরা একই ইউনিয়নের সাহেবপাড়া বেরুলি, জিয়েলগাড়ি, বড়হিজলি, ডেকাটি ও বেরুলি গ্রামের বাসিন্দা। তাঁদের নামের পাশে দেওয়া মোবাইল ফোন নম্বরের ৪০টি একটি অপারেটর কোম্পানির। ১০টি অপর কোম্পানির। সিরিয়ালও কাছাকাছি। সব নম্বরই বন্ধ। প্রকল্প স্থান থেকে সাহেবপাড়া বেরুলি গ্রামের দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। ওই গ্রামে গিয়ে তালিকায় থাকা কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। সহোদর মিরাজুল ইসলাম ও বিলায়েত মন্ডল বাড়িতে ছিলেন না। তবে দেখা যায়, বেশ অবস্থাপন্ন তাঁরা। মিরাজুলের স্ত্রী তানজিলা বলেন, তাঁর স্বামী কৃষক। বিলায়েত বিদেশে থাকেন। তাঁরা কখনও মাটি কাটার কাজ করেননি। তালিকায় কীভাবে নাম দেওয়া হয়েছে তা তাঁরা জানেন না।

শ্রমিকের তালিকায় ছেলেদের নাম আছে শুনে রেগে যান মিরাজুল-বিলায়েতের মা। তিনি বলেন, 'এসব কাজ আমার ব্যাটারা কখনও করেনি।'

একই গ্রামের রাজু মণ্ডলের গোয়ালঘরে রয়েছে চারটি বড় গরু। তিনিও বেশ সচ্ছল। রাজু বলেন, এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। তালিকায় থাকা মোবাইল নম্বরটিও তাঁর নয়। তাঁর ভাষ্য, কোনো একটা কাজে একবার ইউনিয়ন পরিষদে আইডি কার্ড দিয়েছিলেন। সেখান থেকেই হয়তো তাঁর নাম দিয়েছে।

ওই গ্রামের ভবেশ চন্দ্র শীলের বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, তিনি শ্বশুরবাড়ি গেছেন। তাঁর মা দুখিনী শীল বলেন, ছেলে রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করে। সহজ-সরল প্রকৃতির ভবেশকে ভাতা দেওয়ার কথা বলে আইডি কার্ড নেওয়া হয়েছিল। এরপর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আর যোগাযোগ করেননি কেউ। শ্রমিকের তালিকায় নাম কীভাবে গেছে জানেন না। কেউ কখনও কিছু বলেওনি।

একই গ্রামের জমিন মোল্লা, আকবর আলী, আব্দুর রাজ্জাক, মুকুল হোসেনের নাম থাকলেও তাঁরা একই রকম মন্তব্য করেন। স্থানীয় বাসিন্দা তোজাম্মেল বলেন, এলাকার কেউ ইউনিয়ন পরিষদের প্রকল্পে কাজ করলে তো জানতেন!

ওই প্রকল্পের সভাপতি ৭, ৮, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী সদস্য আছমা বেগম। তাঁর মোবাইল ফোন নম্বরে কল দেওয়া হলে বোন পরিচয় দেওয়া এক নারী ধরেন। তিনি বলেন, 'আছমা বেগম অসুস্থ। কথা বলতে পারবেন না।'

একই চিত্র বড় হিজলী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ইমারতের বাড়ি পর্যন্ত মাটি দিয়ে রাস্তা সংস্কার কাজেও। যেখানে কাজ শেষ হওয়ার কথা সেই বাড়ির ইমারত হোসেন বলেন, কয়েকদিন আগে সেখানে মাত্র চার ট্রাক মাটি ফেলা হয়েছে। আর কোনো কাজ করতে দেখেননি।

প্রকল্পটিতে যে ৬০ জন শ্রমিকের নাম দেওয়া আছে, তাঁদের পাশে লেখা সব মোবাইল ফোন নম্বরই বন্ধ পাওয়া যায়। এ প্রকল্পের সভাপতি ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য কামরুজ্জামান চাঁদ। তিনি বলেন, ওখানে কয়েক ট্রাক মাটি দেওয়া হয়েছে। সব কাজ শ্রমিকরা করেনি বলে স্বীকার করেন। তাঁর ভাষ্য, 'মিলে-ঝিলে কাজ হয়েছে।'
নবাবপুর ইউপি চেয়ারম্যান বাদশাহ আলমগীর বলেন, 'প্রকল্পটি দেওয়ার সময় দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দেওয়ার শর্ত ছিল। ওই স্কুলের (সোনাইকুড়ী) আশপাশে কোনো মাটি নেই। শ্রমিক দিয়ে কোন জায়গা থেকে মাটি আনাব?' তাঁর ভাষ্য, সেখানে মাটি কিনে এনে দেওয়া ছাড়া সম্ভব ছিল না, শ্রমিকদের দিয়ে করানোও সম্ভব ছিল না। 'লেবার দিয়ে ড্যান্স পারালে কি মাটি আসবে?' বিদ্রূপাত্মক প্রশ্ন ছুড়ে তিনি বলেন, 'প্রকল্প অনেক আগেই চলে গেছে। কোথাও মাটির হদিস পাইনি। এখন মাটি পেয়েছি, ভরাট করে দিয়েছি।'

তাঁদের ওপর নির্দেশনা ছিল বলেই সমন্বয় করে কাজ করেছেন-এমন দাবি করেন চেয়ারম্যান আলমগীর। তিনি আরও বলেন, 'আরেকটি রাস্তার কাজের জন্য মাটি ছিল না। আংশিক মাটি পেয়েছি, তা কিনে এনে কাজ করেছি।'

তালিকায় অনিয়মের বিষয়ে প্রশ্ন করলে চুপ করে যান তিনি। খানিক পর বলেন, 'যারা শ্রমিক আছে, কেউ দুইশ টাকার শ্রমিক হিসেবেও কাজ করে না। আপনার উচিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলা।'

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) নাসরিন সুলতানা বলেন, ৪০ দিনের প্রকল্পটি ২০২২ সালের ২৬ নভেম্বর শুরু হয়, যা শেষ হয়েছে চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দুই কিস্তিতে শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে প্রথম কিস্তির টাকা দেওয়া হয়েছে।

নবাবপুর ইউনিয়নে এ প্রকল্পের অনিয়ম সম্পর্কে তিনি বলেন, 'স্কুলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটা প্রকল্প পেয়েছিলাম। যে সময় কাজটা চলছিল, তখন হয়তো মাটি পাওয়া যায়নি। বাইরে থেকে কিনে ভরাট হয়েছে।'

তালিকায় নাম থাকা শ্রমিকদের মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ আছে জানানো হয় তাঁকে। এখন মজুরির টাকা কে পাবেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা খোঁজখবর নিয়ে দেখতে হবে।

ওই প্রকল্পের বিষয়ে আগেও অভিযোগ পেয়েছেন বলে জানান ইউএনও রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, চেয়ারম্যানকে বলা হয়েছে, হতদরিদ্র শ্রমিক দিয়ে কাজ না করালে কোনো বিল দেওয়া হবে না। মেশিন ব্যবহার করে মাটি কাটায় তাঁর সমর্থন নেই জানিয়ে বলেন, এতে সরকারের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।