
করোনা মহামারির কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের মানুষ শুধু মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁঁকির সম্মুখীনই হয়নি; তাদের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়েছে। তাদের অধিকাংশ করোনার চেয়েও জীবিকা নিয়ে বেশি বিচলিত। তারা বলেছে, করোনায় বাঁচলেও অভাবে বাঁচা কঠিন। জীবন চালিয়ে নিতে মধ্যবিত্তরা সঞ্চয়ে হাত দিতে বাধ্য হয়েছে- এমন সংবাদ আমরা দেখেছি। অনেকে রোজগার হারালেও সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার সহায়তা পায়নি, এমন সংবাদও জানা গেছে। করোনা সংকটে সবচেয়ে বিপদে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ, বিশেষ করে যারা অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করত কিংবা ছোটখাটো ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করত। তাদের অনেকের আবার জীবিকা থাকলেও মাসিক আয় হ্রাস পেয়েছে ব্যাপকভাবে।
তবে করোনার এই ক্ষয়ক্ষতির আরও একটি ভয়াবহ দিক জানা যাচ্ছে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটি বলছে, করোনার প্রভাবে দেশের মানবসম্পদ ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছে। এর ফলে লাখো শিশু এবং তরুণের বিকাশ সরাসরি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তাদের অনুধাবন শক্তি দুর্বল হয়েছে, যা তাদের সারাজীবনের আয়-সক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। এর ফলে অর্থনৈতিক অবস্থা বিপন্ন হবে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এর ফলে বাংলাদেশের স্বাভাবিক যে আয় হতে পারত, করোনার কারণে তা প্রায় ২৫ শতাংশ কমবে। এ অবস্থা বিশ্ব অর্থনীতিতেও প্রভাব রাখবে। বৈশ্বিক এই সংস্থাটি বলছে, এতে বিশ্বব্যাপী ক্ষতি হবে ২১ ট্রিলিয়ন ডলার। বিভিন্ন দেশের তথ্যের প্রাথমিক বিশ্নেষণধর্মী এ প্রতিবেদন ২৫ বছরের কম বয়সীদের ওপর করোনার প্রভাব নিয়ে গবেষণার ভিত্তিতে তৈরি বলে জানানো হয়েছে।
শিশুদের ওপর পরীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের চেয়ে '২২ সালের পরীক্ষায় শিশুরা বেশ পিছিয়ে আছে। এই পিছিয়ে থাকার কারণে এসব শিশুর পরিণত বয়সে আয় কমবে স্বাভাবিক আয়ের চেয়ে অন্তত ২৫ শতাংশ।
এদিকে কঠিন বাস্তবতা হলো, করোনার কারণে মানুষের রোজগার কমে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীও তারা কিনতে পারছে না। ফলে শিশুদের যে পরিমাণ পুষ্টি প্রয়োজন, তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাহত হচ্ছে তাদের স্বাস্থ্যসেবাও। অন্যদিকে শহরাঞ্চল থেকে কাজ হারিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ গ্রামে ফিরে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট জনস্রোত গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাপ বাড়াবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সব খাতই চলমান করোনাভাইরাস মহামারির ছোবলে ক্ষতিগ্রস্ত।
আমরা জানি, প্রাক-শৈশবকাল মেধা বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। জীবন দক্ষতার ভিত্তিভূমি বলা হয় এ সময়কে। করোনাকালে লকডাউনসহ বিভিন্ন কারণে অনেক শিশু স্কুলে যেতে পারেনি। করোনায় সারাবিশ্বেই বিভিন্ন সময়ের জন্য স্কুল বন্ধ ছিল। নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে স্কুল বন্ধ ছিল এক বছরের মতো। এ কারণে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক টিকা থেকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার টিকা পায়নি অনেক শিশু। দরিদ্র পরিবারের প্রাক-শৈশব, বিদ্যালয়গামী বয়সের শিশু ও তরুণদের পরিস্থিতি তুলনামূলক খারাপ। এতে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বৈষম্য আরও বাড়তে পারে। আমাদের দেশে এখন যাদের বয়স ২৫-এর নিচে, তাঁরাই ২০৫০ সালের শ্রমবাজারের ৯০ শতাংশ জোগান হবেন। প্রকৃত ক্ষতির বিষয়টি তখন পরিস্কার হয়ে উঠবে। করোনার সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘ মেয়াদে বন্ধ থাকার যে প্রভাব, তা কমিয়ে আনতে হবে। পিছিয়ে থাকা শিশুদের এগিয়ে আনতে হবে সমান সুযোগ নিশ্চিত করে।
এটা নিশ্চিত, বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির দেশে করোনা মহামারি বেশ কিছু ঝুঁকি কয়েক গুণ করেছে। অর্থনীতির মৌলিক দিকগুলোর বাইরের ধাক্কা সহ্য করার সক্ষমতা যে নড়বড়ে ছিল- তা এই করোনা মহামারি জানান দিল। এখন বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে যে আশঙ্কা জানিয়েছে, তা থেকে রেহাই পেতে প্রথমত করোনার অভিঘাত কাটিয়ে আগের অবস্থায় ফিরে যেতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, করোনার আগে অর্থনীতিতে যেসব দুর্বলতা বা ঝুঁকি ছিল, সেগুলো কাটাতে হবে। নইলে বাংলাদেশের যে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন, তা অধরাই থেকে যাবে।
এহ্সান মাহমুদ: সহসম্পাদক, সমকাল
মন্তব্য করুন