বাগেরহাট জেলা শহর থেকে কচুয়া উপজেলার বগা ভাষা গ্রামের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। জেলেপল্লি নামে পরিচিত গ্রামটি। এই গ্রামের বেশিরভাগ জীবিকা নির্বাহ করেন সাগরে মাছ ধরে। সাগরের ঢেউয়ের মতোই দোদুল্যমান তাঁদের জীবন।

এই গ্রামের জেলে মহিদুল মোল্লা (৩৫)। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সাগরে বেশ কয়েকজন জেলের সঙ্গে ট্রলারে করে তিনিও মাছ ধরতে যান। ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবনসংলগ্ন দুবলার চরে ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায় ২১টি ট্রলার। এর মধ্যে অনেক জেলে সাঁতরে নিরাপদে আসতে পারলেও মারা যান সাতজন। তাদের একজন মহিদুল।

গত সোমবার মহিদুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনের চাল ও কাঠের বেড়া দেওয়া ঘরটিতে তাঁর মা-স্ত্রী-সন্তান বসবাস করছেন। অনেকটা জরজীর্ণ ঘরের বারান্দায় বসে জাল মেরামত করছেন মহিদুলের স্ত্রী মুর্শিদা বেগম। পাশেই বসে ছিলেন মহিদুলের মা হাসিনা বেগম।
হাসিনা বেগম জানান, মহিদুল তাঁর একমাত্র ছেলে। যাওয়ার সময় বলে গেছেন যে, 'মা পয়সা-কড়ি থুইয়ে যাইতে পারলাম না। যা আছে তাই অল্প অল্প করে খাইয়ো। আর আল্লাহ আল্লাহ কইরো। আমি কয়েক দিনের মধ্যে আসতেছি। তহন আল্লাহ দিলে ভালো-মন্দ খাইয়ো।' ছেলের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন এই বৃদ্ধা। তিনি চোখ মুছতে মুছতে বলেন, 'তারপর থেকে সব অন্ধকার। আমি ছেলের মুখখানও দেখতে পারলাম না।'

মহিদুল মোল্লার তিন ছেলের মধ্যে তরিকুল ইসলাম (১৫) সবার বড়। ১৭ পারা কোরআনের হাফেজ সে। দুই ছেলে আরিফুল (১৩) ও আবির (৯) স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের সপ্তম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাবার মৃত্যুর পর তরিকুল পড়ালেখা ছেড়ে ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ নেয়।
মুর্শিদা বেগম বলেন, 'বড় ছেলেরে ১৭ পারার হাফেজ বানিয়েছিলাম। ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে খুব কষ্টে আছি। বাচ্চাদের পরীক্ষার ফিও দিতে পারিনি। যেভাবে সবকিছুর দাম বেড়েছে, সামনে কীভাবে চলব জানি না।'

একই গ্রামের বাসিন্দা নূরনাহার বেগম। তাঁর স্বামীর নাম ওলিয়ার মোল্লা। তাঁর স্বামীও মাছ ধরতে গিয়ে মারা গেছেন ২০১৫ সালে। তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরটি টিনের তৈরি হলেও জরাজীর্ণ। ঘরের বারান্দায় বসে মাছ ধরার জাল ঠিক করছেন বৃদ্ধা। তিনি বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর ঘোর অমানিশা নেমে আসে তাঁর জীবনে। ছোট দুই ছেলে নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছেন। মানুষের বাড়িতেও কাজ করেন।

নুরনাহার আক্ষেপ করে বলেন, 'সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে মারা যাওয়াদের জন্য কত সাহায্য আসে, কিন্তু এখনও সহযোগিতা পাইনি। দিনের পর দিন একটু শাক বা পানি দিয়ে ভাত খাই। সাগর থেকে কেউ দুই-একটি মাছ দিলে তখন ছেলেদের মাছ-ভাত দিতে পারি।'
মহিদুল মোল্লা ও ওলিয়ার মোল্লার পরিবারের মতো একই অবস্থা মাছ ধরতে গিয়ে ফিরে না আসা গ্রামটির অন্তত অর্ধশত পরিবারের।

কথা হয় স্বামী হারানো মরিয়ম বেগমের সঙ্গে। তাঁর স্বামীর নাম মো. তালেব। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে চারজনের পরিবার তাঁর। তিনি বলেন, 'সাগর থেকে স্বামী ফেরেননি আট বছর হলো। টেনেটুনে চললেও দিনে সংসারের খরচ ৩০০ টাকা। জাল বুনে, পুকুরে মাছ ধরে আয় হয় ১০০ থেকে ২০০ টাকা। কীভাবে যে দিন কাটে, তা শুধু আমরাই জানি।'

ইউএনও তাছমিনা খাতুন বলেন, বগা গ্রামের যেসব জেলের পরিবার সরকারি সহযোগিতার আওতায় আসেনি, তাদের বিষয়ে খোঁজ নেবেন তিনি।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এএসএম রাসেল বলেন, এক বছরে কচুয়ার পাঁচটি পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে সাহায্য দেওয়া হয়েছে। জেলেদের নিরাপত্তায় ৪০০ ট্রলারে 'ভেসেল ট্র্যাকিং মনিটরিং সিস্টেম' বসানো হয়েছে।