বাজারজাত নিষিদ্ধ হলেও মেহেরপুর জেলায় নোট বা গাইড বই বিক্রির ধুম পড়েছে। জেলা ও উপজেলা শহরের লাইব্রেরিগুলোতে বেচাকেনা চলছে এসব বই। কিছু শিক্ষক ও প্রকাশনীর প্রতিনিধিদের প্ররোচনায় শিক্ষার্থীরা সহায়ক নামে গাইড কিনতে বাধ্য হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে নোট বা গাইড নয়, সহায়ক বই বিক্রি করছেন বলে দাবি করেছেন বই বিক্রেতারা।

সৃজনশীল মেধা বিকাশ নিশ্চিত করতে ২০০৮ সালে হাইকোর্ট বিভাগের এক আদেশে নোট বইয়ের পাশাপাশি গাইডও নিষিদ্ধ করা হয়। আইনটি লঙ্ঘনের দায়ে সর্বোচ্চ সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।
জেলার বিভিন্ন বইয়ের দোকান ঘুরে দেখা গেছে, বছরের শুরু থেকে বিভিন্ন প্রকাশনীর নোট ও গাইড বইয়ে সয়লাব বইয়ের দোকানগুলো। তৃতীয় শ্রেণির গাইড বই ৫৩০ টাকা, চতুর্থ শ্রেণির ৬০০, পঞ্চম শ্রেণির ৮৫০, অষ্টম শ্রেণির ১ হাজার ৪৯০ এবং নবম শ্রেণির ৬ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির গাইড বা নোট এখনও বাজারে আসেনি।

নিষিদ্ধ নোট-গাইড বিষয়ে চিঠি দিয়ে শিক্ষকদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ভূপেশ রঞ্জন রায়। তিনি বলেন, শিক্ষকরা নোট-গাইড কিনতে বাধ্য কিংবা উৎসাহিত করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির দেখা যায়নি। জেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬৭ হাজার ৮৮৮ এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৩৯ হাজার ৬৩৮।

গাংনী, মেহেরপুর শহরে ও মুজিবনগরের অন্তত পাঁচটি বইয়ের দোকানের তত্ত্বাবধায়নে জেলাজুড়ে নোট ও গাইড বই বিক্রি হয় বলে দাবি শিক্ষক ও বই বিক্রেতাদের। গাংনীর রায়পুর গ্রামের বাসিন্দা হামিদুল ইসলাম। পেশায় একজন ভ্যানচালক। তিনি বলেন, 'সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয়। তার ওপর মেয়েদের পড়াশোনার খরচ। এর মধ্যে উচ্চমূল্যের গাইড বই। শিক্ষিত করার স্বপ্নে কিছুদিন আগে মেয়েকে কিনে দিয়েছি গাইড বই। শিক্ষকরা বলে দিয়েছেন কোন কোম্পানির গাইড বই কিনতে হবে। বাধ্য হয়ে গাইড বই কিনতে হচ্ছে।'
গাংনীর বই জগৎ থেকে পুথিনিলয় প্রকাশনীর চতুর্থ শ্রেণির গাইড কিনতে হয়েছে বলে দাবি করেন স্থানীয় লাল্টু মিয়া।

সদর উপজেলার থানাপাড়া এলাকার শরিফুল ইসলাম ভাষ্য, কিছু শিক্ষক বই বিক্রেতাদের সঙ্গে চুক্তি করে গাইড কেনার পরামর্শ দিচ্ছেন। বিনিময়ে বিক্রেতার কাছ থেকে নিচ্ছেন কমিশন। সুযোগ বুঝে বিক্রেতারাও বই বেশি দামে বিক্রি করছেন।

শহরের মিনি গড়পাড়ার মনিরুল ইসলামের দাবি, নোট ও গাইড বিক্রির লাভের কমিশন পাচ্ছে বই বিক্রেতা সমিতি ও শিক্ষক নেতৃবৃন্দ। সমিতির কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সাধারণ সদস্যরা। তাদের নির্ধারিত দামে বিক্রি না করলে ২০ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করেছে সমিতি।
ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী সুলতানা জানায়, শিক্ষকরা নির্ধারিত প্রকাশনীর নোট বা গাইড বই কিনতে নির্দেশ দেন। অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানায়, শিক্ষকদের কথামতো গাইড না কিনলে রাগ করেন তাঁরা।

সমিতির এক সদস্যের বক্তব্য, সমিতির নিয়ম মেনে বই বিক্রি করলে বেশি লাভ হয়, তবে ঠকেন ক্রেতা। জরিমানার ভয়ে কম লাভে কেউ বই বিক্রি করতে পারেন না।

জেলা বই বিক্রেতা সমিতির সাধারণ সম্পাদক বাবর আলী বাবু বলেন, ৬০ হাজার টাকা দিয়ে সমিতির সদস্য হতে হয়। তাই সমিতি নির্ধারিত দামে বই বিক্রি করতে বলা হয়। সমিতি নির্ধারিত দামের কমে কেউ সহায়ক বই বিক্রি করলে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
অভিভাবক আব্দুল হালিম বলেন, শিক্ষকরাই বিভিন্ন প্রকাশনীর নোট-গাইডের সহায়তা নেওয়ার কথা বলেন। শিক্ষকের কথা শুনে শিক্ষার্থীরা বাড়িতে এসে বায়না করে গাইড কিনে দিতে। এসব গাইড-নোটের দাম আকাশছোঁয়া। দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা সবচেয়ে বিপাকে পড়ে। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় নিষিদ্ধ নোট-গাইডের প্রচলনে সরকারের উদ্যোগ সফল হচ্ছে না।

বিদ্যালয়ের শিক্ষক বা লাইব্রেরির মালিকদের সঙ্গে নোট বা গাইড বইয়ের বিষয়ে কোনো লেনদেন হয় না বলে দাবি করেছেন লেকচার প্রকাশনীর বিক্রয় প্রতিনিধি রুবেল হোসেন। তিনি বলেন, বই (নোট বা গাইড) বিক্রির প্রচরণার জন্য বিভিন্ন লাইব্রেরি ও শিক্ষকদের কাছে যান তাঁরা।
বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাহিদামতো নির্দিষ্ট প্রকাশনীর বই ঢাকা থেকে নিয়ে আসা হয় বলে জানিয়েছেন সমিতির সভাপতি এসএম পাপ্পু। তবে এ জন্য টাকাপয়সার লেনদেন হয় না বলে দাবি তাঁর।

অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গাংনী সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পারভেজ সাজ্জাদ রাজা। তিনি দাবি করেন, নোট বা গাইড কিনতে নিরুৎসাহিত করছেন তাঁরা। সিএইচএস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রশিদ বলেন, নোট বা গাইড কিনতে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেন না। পাশাপাশি বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দেখে তাঁদের শিক্ষার্থীরাও সহায়ক বই কিনে থাকে। তবে বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন।

সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী গাউড বিক্রি নিষিদ্ধ থাকলেও ছাপা ও বিক্রি হচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মাহফুজুল হোসেন। তিনি বলেন, সরকারি নির্দেশনা সব স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হলেও এসব বই কিনছে শিক্ষার্থীরা।

বিষয় : গাইড বই বিক্রি নিষিদ্ধ গাইড বই

মন্তব্য করুন