মো. রোকনুজ্জামান, ময়মনসিংহের ফুলপুরের রামভদ্রপুর ইউনিয়ন পরিষদের টানা তিনবারের চেয়ারম্যান। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে দহরম-মহরম থাকলেও করেন বিএনপি। তাঁর অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কাছে অসহায় ইউনিয়নবাসী। অন্যের জমি দখল, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অনিয়ম-দুর্নীতি, কারণে-অকারণে প্রতিপক্ষকে মারধর– এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তিনি করেন না! রোকনুজ্জামানের বিরুদ্ধে টাকা ছড়িয়ে, সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে ইউনিয়নে ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।

সরেজমিন সমকালের বিশেষ দল রোকনুজ্জামানের অপকর্মের ফিরিস্তি পেয়েছে। তবে রামভদ্রপুর ইউনিয়নের সাধারণ বাসিন্দা কেউই ভয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে চান না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকের দাবি, বিএনপি করলেও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতার ছত্রছায়ায় রোকনুজ্জামান এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করেছেন। ইতোমধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, বিস্ফোরক, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ১১টি মামলা হয়েছে। সর্বশেষ গত ১২ ফেব্রুয়ারি একটি মামলা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইউনিয়নের চরবাহাদুরপুর গ্রামে কাজল মিয়া ও তাঁর চাচাতো ভাই গিয়াস উদ্দিনের মধ্যে জমি নিয়ে পারিবারিক বিরোধ দেখা দেয়। এতে কাজলের পক্ষ নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর চড়াও হন রোকনুজ্জামান। ২০১২ সালের আগস্টে জমি দখল, বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগে গিয়াস উদ্দিনের ছেলে আজহারুল হক বাদী হয়ে রোকনুজ্জামানসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর পর ওই বছরের নভেম্বরে চেয়ারম্যানের সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে খুন হন বাদীর আত্মীয় আবদুল আলিম। ইউনিয়নের বাঘেধরা গ্রামের ফাতেমা আক্তার নামে এক নারীকে মারধরের অভিযোগ রয়েছে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। তাঁর অত্যাচারে স্থানীয় লোকমান মিস্ত্রি পুরো পরিবার নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন বলে জানিয়েছেন ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে রোকনুজ্জামানের ভাগ্য বদলাতে শুরু করে। টিআর-কাবিখা বাস্তবায়নের নামে লোপাট এমনকি জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়ার জন্যও টাকা আদায় করেন তিনি।’

সরেজমিন জানা গেছে, সরকারি প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। গড়েছেন ‘সততা ব্রিকস’ নামে দুটি ইটভাটা। নামে-বেনামে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। রামভদ্রপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক আবদুল হাইয়ের বাড়ির সামনের ৪০ শতাংশ জমি দখলে ইন্ধন দিয়েছেন রোকনুজ্জামান। আবদুল হাই সমকালকে বলেন, চাচাতো ভাই আবদুল হামেদ ১৯৬০ সালে ২৪ শতক ও আবদুল তাহের ১৯৬৬ সালে ১৬ শতক পৈতৃক জমি বিক্রি করেন এলাকার জরিনা খাতুনের কাছে। ১৯৬৮ সালে জরিনার কাছ থেকে জমিগুলো কিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বিআরএস জরিপে জমির মালিক দেখানো হয় আবদুল হামেদ ও আবদুল তাহেরের সৎভাই আবদুল আউয়ালকে। জরিপে জমির দখলদার হিসেবে আমার নাম থাকলেও ২০১৭ সালে চেয়ারম্যানের সহায়তায় ওই জমি দখল করে নেন আবদুল আউয়ালের ছেলে তোফাজ্জল হোসেন ও চানু মিয়া।

শিক্ষক আবদুল হাই জরিপে ওই জমির ভুল রেকর্ড সংশোধনের মামলা করেন। মামলাটি বিচারাধীন। আদালত জমিতে উভয়পক্ষকে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা দিলেও দখলে রেখেছেন চেয়ারম্যানের আত্মীয় তোফাজ্জল হোসেন।

চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে সদস্যদের অনাস্থা : রামভদ্রপুর ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষুব্ধ আট সদস্য ২০২০ সালের ৯ মে সভা করে রোকনুজ্জামানের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানান। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সদস্য গোলাম কিবরিয়া। সভার রেজ্যুলেশনে বলা হয়, সদস্যরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও চেয়ারম্যানের কারণে উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারছেন না। চেয়ারম্যান সন্ত্রাসী বাহিনী লালন ও পেশিশক্তির মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। সদস্যদের মূল্যায়ন নেই। কিছু বলতে গেলে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দুস্থদের চাল পরিমাণে কম দেওয়ার প্রতিবাদ করে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন সদস্য রফিকুল ইসলাম। পরে প্রতিকার চেয়ে ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ দেন তিনি। অনাস্থা প্রস্তাব ইউএনও, ডিসি, বিভাগীয় কমিশনার, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হলেও অদৃশ্য কারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

রামভদ্রপুর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু বাক্কার সিদ্দিক সমকালকে বলেন, ‘এলাকার সমস্যা সমাধানে গিয়ে চেয়ারম্যান রোকনুজ্জামান সব সময় পছন্দের পক্ষে রায় দেন। অন্যপক্ষকে আতঙ্কে রাখতে বাহিনী দিয়ে অত্যাচার করেন। বরাদ্দের ৩৫০ টাকা করে গরিবদের না দিয়ে মাস্টার রোলে ভুয়া স্বাক্ষরে তুলে আত্মসাৎ করেন চেয়ারম্যান। প্রতিবাদ করলে আমার সঙ্গেও তাঁর ঝামেলা হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘রোকনুজ্জামান বিএনপির লোক। তিনি কখনোই আওয়ামী লীগের লোকজনের পাশে দাঁড়ান না। বাহিনী দিয়ে এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রতিপক্ষ দমনে খুন করতেও দ্বিধা করেন না।’

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে রোকনুজ্জামান সমকালকে বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে আমার বিরুদ্ধে খুনসহ অর্ধশতাধিক মামলা হয়েছে। পরে সবই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে কিছু বিস্ফোরক মামলা বিচারাধীন।’ এ সময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন তিনি।