- সারাদেশ
- খুলনায় রোগীদের জিম্মি করে চিকিৎসকদের কর্মবিরতি
খুলনায় রোগীদের জিম্মি করে চিকিৎসকদের কর্মবিরতি

চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে বৃহস্পতিবার খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে দুর্ভোগে পড়েন রোগীরা সমকাল
বরগুনার বামনা উপজেলা সদর থেকে শ্বাসকষ্টের চিকিৎসার জন্য বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টায় খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে আসেন ফারুক হোসেন। এসে দেখেন কর্মবিরতি চলছে চিকিৎসকদের। প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর বাবাকে নিয়ে ফিরে যান তিনি। যাওয়ার সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ভালো চিকিৎসার জন্য বুধবার সকালে তাঁরা এই হাসপাতালে আসেন। তখন স্টাফরা বলেছিলেন, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ডাক্তাররা চিকিৎসা দেবেন। কিন্তু এখনও কর্মবিরতি চলছে। তাই নিরুপায় হয়ে বরগুনা ফিরে যাচ্ছি।
সাতক্ষীরা সদর থেকে ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে বুধবার এই হাসপাতালে আসেন সেলিনা বেগম নামে এক গৃহবধূ। চিকিৎসা না পেয়ে রাতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলেন। বৃহস্পতিবার সকালে আবারও এসে দেখেন কর্মবিরতি প্রত্যাহার হয়নি।
হতাশার সুরে বলেন, গরিব মানুষ, এখানে স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা নিতে এসেছিলাম। এখন বাড়ি ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই!
শুধু এই দু’জনই নন, চিকিৎসকদের টানা কর্মবিরতির কারণে খুমেক হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসাবঞ্চিত হন প্রায় দেড় হাজার রোগী। শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল, খুলনা জেনারেল হাসপাতাল, ৯টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে ছিল দুর্ভোগের একই চিত্র। রোগীদের জিম্মি করে চিকিৎসকদের আন্দোলন নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে রোগী এবং খুলনার সাধারণ মানুষের মধ্যে। খুলনা বিভাগীয় কমিশনার ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কেন্দ্রীয় সভাপতির নির্দেশনার পরও কর্মবিরতি প্রত্যাহার করেনি খুলনা বিএমএ।
চিকিৎসকরা জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী বিএমএ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় তিনি রোগীদের দুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তাঁদের কর্মবিরতি প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। এ ছাড়া বিএমএর কেন্দ্রীয় সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন খুলনা বিএমএ নেতাদের ফোন করে একই নির্দেশনা দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সকালে শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল চত্বরে যে বিক্ষোভ সমাবেশ করার কর্মসূচি ছিল, তা বাতিল করা হয়।
এদিকে, সকাল ৯টার দিকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের নির্দেশে বহির্বিভাগে রোগীদের টিকিট দেওয়া শুরু হয়। বলা হয়, শিগগিরই চিকিৎসকরা রোগী দেখবেন।
আধা ঘণ্টায় প্রায় ৪০ জনকে টিকিট দেওয়ার পর কাউন্টার বন্ধ করে দেওয়া হয়। টিকিটপ্রাপ্তরা আশায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত ডাক্তার দেখাতে পারেননি।
গতকাল সকাল ১১টায় খুলনা বিএমএ কার্যালয়ে জরুরি সভা করেন চিকিৎসকরা। ঊর্ধ্বতনদের কর্মবিরতি প্রত্যাহারে নির্দেশ থাকলেও প্রায় তিন ঘণ্টার সভায় কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। জরুরি সভা শেষে খুলনার বিএমএ সভাপতি ডা. শেখ বাহারুল আলম জানান, ডা. নিশাত আবদুল্লাহর ওপর হামলাকারী পুলিশের এএসআই নাঈমকে গ্রেপ্তার এবং দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসকদের কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে।
আগামীকাল শনিবার দুপুর ১২টায় আবু নাসের হাসপাতাল চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশেরও ডাক দেওয়া হয়। এ ছাড়া ওই দিন সন্ধ্যায় বিএমএ কার্যালয়ে সাধারণ সভা করা হবে। ওই সভায় সবার মতামতের ভিত্তিতে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
খুলনার বিএমএ সভাপতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পুলিশ পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করছে। চিকিৎসকের ওপর হামলাকারী পুলিশ সদস্য হওয়ায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। যদি তাঁদের দাবি পূরণ না হয়, তাহলে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ এবং প্রয়োজনে গণপদত্যাগ করার হুঁশিয়ারি দেন।
সাতক্ষীরা জেলার পুলিশ সুপার জানান, এএসআই নাঈমুজ্জামান শেখকে বৃহস্পতিবার সকালে পুলিশ লাইন্সে ক্লোজ করা হয়েছে।
নগরীর সোনাডাঙ্গা থানার ওসি মমতাজুল হক বলেন, হামলার অভিযোগে ডা. নিশাত আবদুল্লাহ গত মঙ্গলবার মামলা করেন। আর শ্লীলতাহানির চেষ্টা ও মেয়ের অঙ্গহানির অভিযোগে বুধবার মামলা করেন এএসআই নাঈমের স্ত্রী নুসরাত আরা ময়না। তাঁরা ইতোমধ্যে দুটি মামলার তদন্ত শুরু করেছেন। হামলার ঘটনাস্থল হক নার্সিং হোম থেকে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ছাড়া দুটি মামলার বিভিন্ন আলামত ও কাগজপত্র সংগ্রহ করা হচ্ছে।
রোগী জিম্মির আন্দোলনে ক্ষুব্ধ নাগরিক নেতারা : কর্মবিরতির নামে হাসপাতালের সাধারণ রোগীদের জিম্মি করে দাবি আদায়ের চেষ্টায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খুলনার নাগরিক নেতারা। তাঁরা অবিলম্বে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে রোগীদের সেবায় যোগ দিতে চিকিৎসকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) খুলনার সভাপতি অ্যাডভোকেট কুদরত ই খুদা সমকালকে বলেন, যে কোনো ঘটনার একটি বিচার প্রক্রিয়া আছে। কিন্তু হাসপাতাল বন্ধ, অসুস্থ রোগীদের জিম্মি করে আন্দোলন কোনোভাবেই উচিত নয়। তাঁদের হঠকারী সিদ্ধান্তে অনেক রোগী মৃত্যু শয্যায়। মানুষ মেরে আন্দোলন কখনোই গ্রহণযোগ্যতা পায় না।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা খুলনার সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম বলেন, চিকিৎসকদের একতরফা আন্দোলনে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে গেছে। আজ যদি সহকর্মীর পক্ষে পুলিশরা কর্মবিরতি শুরু করে তাহলে দেশের কী পরিস্থিতি হবে? তাদের কাছ থেকে চিকিৎসক নেতাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।
ডা. নিশাতের কঠোর শাস্তির দাবি ভুক্তভোগীর : গতকাল দুপুরে খুলনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন ভুক্তভোগীর স্ত্রী নুসরাত আরা ময়না। তিনি শ্লীলতাহানি ও স্বামীকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির জন্য ডা. নিশাত আব্দুল্লাহর কঠোর বিচার দাবি করেন। একই সঙ্গে তাঁদের অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়াতে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতি অনুরোধ জানান।
তিনি বলেন, মিথ্যা মামলা দিয়ে আমার স্বামীকে হয়রানি ও আমার মেয়েকে চিকিৎসাবঞ্চিত করা হচ্ছে। এর ফলে আমার মেয়ের হাতের অবস্থার যে অবনতি হচ্ছে এই দায়ভার কে নেবে? শুধু আমার মেয়ে নয়, চিকিৎসকরা কর্মবিরতির নামে সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা না দিয়ে তাদের জীবন নিয়ে যে ছেলেখেলা করছেন, তার দায়ভার কে নেবে– প্রশ্ন রাখেন তিনি।
মন্তব্য করুন