মাতৃসূত্রীয় খাসিরা (খাসিয়া) ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০-এর তপশিলভুক্ত জাতিসত্তা। পাহাড়-টিলায় গড়ে তোলা নিজেদের গ্রামকে তারা ‘পুঞ্জি’ বলে। পুঞ্জিপ্রধানকে বলে ‘মন্ত্রী’। লতানো গাছ পানসহ দেশীয় বৃক্ষ প্রজাতিতে ভরপুর থাকে এসব পুঞ্জি। খাসি ও মান্দি জনগোষ্ঠী এসব পুঞ্জির বাসিন্দা। তবে সিলেট বিভাগের আদি খাসি পানপুঞ্জিগুলো আর আগের মতো থাকতে পারছে না। মূলত চা বাগান থেকে উপ-ইজারা নেওয়া এসব পুঞ্জি থেকে উচ্ছেদ হতে হচ্ছে আদি বাসিন্দাদের। পুঞ্জির বহু প্রাচীন বৃক্ষ ও পান গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। খাসিদের জীবন ও জীবিকার ওপর এমন প্রশ্নহীন আক্রমণের সুরাহা হচ্ছে না।

চা নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি বছর প্রতিটি চা বাগানের আড়াই শতাংশ বাগান সম্প্রসারণের নামে বৃক্ষসম্পদে ভরপুর আদি এসব বসতিকে চরম হুমকিতে ফেলা হচ্ছে। চা বাগান হয়তো সম্প্রসারণ দরকার; কিন্তু প্রবীণ বৃক্ষ কেটে মানুষের জীবন-জীবিকাকে সংকটে ফেলে কেন এই সম্প্রসারণ? প্রাণ-প্রকৃতি এবং খাসিপুঞ্জিবান্ধব সম্প্রসারণ নীতি, কৌশল ও ব্যবস্থাপনা কি আমরা তৈরি করতে পারি না?

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ১৯৬৮ সালে ৬৮৬ একর ঝিমাই চা বাগানটি বন্দোবস্ত নেয় কেদারপুর টি কোম্পানি। বন্দোবস্তের পর ৩১০ একর ভূমিতে চা গাছ লাগানো হয় এবং পাঁচ একরে বাগানের অফিস, আবাসিক এলাকা ও কারখানা করা হয়। বাকি ৩৭৬ একরে ঝিমাই খাসিপুঞ্জি। ঝিমাইপুঞ্জি কেদারপুর টি কোম্পানির মালিকানাধীন চা বাগানে পড়েছে। এ পুঞ্জিতে বর্তমানে ৭২ খাসি পরিবারের বাস। ২০১২ সালে সরকার ঝিমাই চা বাগানের জন্য ৬৬১ দশমিক ৫৫ একর ভূমির ইজারা নবায়ন করে। এর ভেতর ঝিমাই খাসিপুঞ্জিও আছে। চা বাগান সম্প্রসারণের নামে চা বাগান কর্তৃপক্ষ এখন ঝিমাইপুঞ্জির প্রায় ২০০০ প্রবীণ-নবীন গাছ কাটতে চাইছে। 

ঝিমাইপুঞ্জির গাছ কাটার পাঁয়তারা বন্ধসহ ১২ দফা দাবিতে ২০২৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আদিবাসী পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের ব্যানারে কুলাউড়ার বঙ্গবন্ধু উদ্যানে পাঁচ শতাধিক মানুষ বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। দেখা গেছে, ঝিমাইপুঞ্জির চলাচলের রাস্তা বারবার নানাভাবে বন্ধ করে রাখে চা বাগান। এ ছাড়া আশপাশের ডুলুকছড়া, বেলকুমা ও নুনছাড়া পুঞ্জিতে খাসিদের নামে লাগাতার হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়।

চা বাগান বন্দোবস্তের চুক্তি অনুযায়ী ২০১৫ সালেও ঝিমাইপুঞ্জির ২০৯৬টি প্রবীণ গাছ কাটতে চায় চা বাগান; কিন্তু খাসিরা গাছকে রক্ষা করে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে ঝিমাই খাসিপুঞ্জি পরিদর্শন করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, কুবরাজ আন্তঃপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠন, বাপা, বেলা, নিজেরা করি, আইপিডিএস, এএলআরডি ও ব্লাস্ট আয়োজিত পরিদর্শন-পরবর্তী আলোচনা সভায় পরিদর্শনকারী দল জানায়, ঝিমাইপুঞ্জিতে চা বাগানের ধারাবাহিক নিপীড়ন এবং পরিবেশ বিনাশের সত্যতা পাওয়া গেছে। কিন্তু চা বাগান কর্তৃপক্ষ তখন গণমাধ্যমকে বলেছিল, খাসিয়াদের আনীত সব অভিযোগ মিথ্যা।  

ঝিমাই শুধু নয়, বহু খাসিপুঞ্জি হারিয়ে গেছে গাছ কেটে চা বাগান সম্প্রসারণ কিংবা জবরদখলের কারণে। বৈরাগীপুঞ্জি, শীতলাপুঞ্জি, জোলেখাপুঞ্জি, নার্সারিপুঞ্জি আর নেই। চা বাগান, বন বিভাগ এবং খাসিপুঞ্জির দ্বন্দ্বে নিহত হয়েছেন ফুলতলার চা শ্রমিক অবিনাশ মুড়া ও নাহারের নিতাই তাঁতি। কুলাউড়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের রেহানা চা বাগানের এক ছোট্ট পানপুঞ্জি কাঁকড়াছড়া। রেহানা চা বাগানের সঙ্গে পুঞ্জির উপ-ইজারা চুক্তিটি ২০১৩ সালে শেষ হয়। বাগান কর্তৃপক্ষ আর চুক্তি নবায়ন করেনি। তারা নির্বিচারে গাছ কেটে সেখানে চায়ের চারা লাগিয়ে দেয়। এভাবে বহু উৎপাদনক্ষম পান ও ফলের জুম কর্তৃপক্ষ দখল করেছে। জীবিকা হারিয়ে ৪৭ পরিবারের ভেতর ৩০ পরিবার উচ্ছেদ হতে বাধ্য হয়েছে। টিকে আছে ১৭ পরিবার।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ১৯৬০ সালে প্রায় ৩৫০ হেক্টর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠে নাহার চা বাগান। এ বাগান থেকে ২০০ একর জায়গা নিয়ে ১৯৮২ সালে গড়ে ওঠে আসলম বা নাহার পুঞ্জি-১। পাশাপাশি কাইলিনপুঞ্জিটি গড়ে ওঠায় সেটিও নাহার পুঞ্জি-২ নামে পরিচিতি পায়। এ পর্যন্ত কয়েকবার নাহার চা বাগানের মালিকানা বদল হয়। ২০০৮ সালের ৩০ জুন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় নাহার চা বাগানের কাইলিন খাসি পানপুঞ্জি এলাকার গাছ কাটার অনুমোদন দেয়। ৭ আগস্ট ২০০৮ তারিখে ৪৭ লাখ ৫১ হাজার ৩৯১ টাকা রাজস্ব নির্ধারণ করে নাহার চা বাগানের বিভিন্ন প্রজাতির ৪ হাজার গাছ কাটার অনাপত্তি দেয় বাংলাদেশ বন বিভাগ। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১০ হাইকোর্টও নাহার পুঞ্জির গাছ কাটার পক্ষে এক প্রতিবেশবিনাশী রায় ঘোষণা করেন। নির্দয়ভাবে নিহত হয় প্রায় ৪ হাজার গাছ।

খাসিপুঞ্জির গাছ কাটা এবং পুঞ্জি জবরদখলকে জায়েজ করতে চা বাগান কর্তৃপক্ষ কিংবা দখলদাররা মিডিয়ায় প্রায়ই বানোয়াট প্রসঙ্গের বিস্তার ঘটান। খোলাবার্তা২৪ডটকম নামক এক অনলাইন পোর্টালে গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি ‘কুলাউড়ায় খাসিয়াদের আগ্রাসী তৎপরতায় বিঘ্নিত হচ্ছে ঝিমাই চা বাগানের উন্নয়ন’ শীর্ষক এক সংবাদে বলা হয়েছে, খাসিয়ারা নিজেদের পান বিক্রির জন্য চা বাগানের রাস্তা ব্যবহার করে, যাতে বাগানের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়! এতে বিভ্রান্তি ছড়াতে আরও বলা হয়– ফিল পতামের ছেলে বর্তমান মন্ত্রী রানা সুরং বিলাসী জীবনযাপন করেন এবং মামলা চালানোর নামে নিরীহ খাসিয়াদের কাছ থেকে জোর করে টাকা নেন এবং তাঁরা চা বাগানের পরিপক্ব গাছ কাটতে বাধা দেন।  উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই সংবাদের বিভ্রান্তিকর আরেকটি অংশ ছিল এ রকম ‘... বনজসম্পদ বিশেষজ্ঞরা জানান, কূলাউড়ার পূর্বে হারারগড় পাহাড়ের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল উজাড় ও বন্যপ্রাণী নিধন করেছে খাসিয়ারা এবং কুলাউড়ার ১৩ হাজার একর বনভূমির ভেতর ৭ হাজার একর বনভূমি জবরদখল করে পান চাষ করে খাসিয়ারা আলিশান জীবনযাপন করছে এবং বনভূমিকে গিলে খাচ্ছে এই সম্প্রদায়।’ 

মৌলভীবাজার, সিলেট ও হবিগঞ্জের খাসি ও মান্দিরা মূলত বন বিভাগ, চা বাগান এবং কিছু খাসজমি এলাকায় বসবাস করেন সত্য। কিন্তু খাসিদের বিশেষ পানজুম স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রে এক সবুজ আবহ তৈরি করে। শুধু জীবন-জীবিকা নয়; এই পানজুম ব্যবস্থাপনা পরিবেশ সংরক্ষণে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান, যা নানা গবেষণায় প্রমাণিত। পানপুঞ্জিগুলো পরিবেশ সুরক্ষা করে জীবন-জীবিকার যে ধরন তৈরি করেছে তা বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে। এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সজাগ থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাই। আশা করব, ঝিমাইপুঞ্জির প্রবীণ বৃক্ষগুলোর জীবন বাঁচাতে রাষ্ট্র ন্যায়পরায়ণ হবে।

পাভেল পার্থ: লেখক ও গবেষক

animistbangla@gmail.com