খুলনার ময়ূর নদীর প্রাণ ফেরাতে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে গত ডিসেম্বরে শুরু হয় খনন। প্রত্যাশা ছিল– এতে নদীর প্রাণ ফিরবে, কমবে খুলনা নগরীর জলাবদ্ধতা। তবে নদীর বাঁকে বাঁকে দখল আর পদে পদে বাধার কারণে ব্যাহত হচ্ছে প্রত্যাশিত সেই খনন।

সম্প্রতি খনন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নদীর বিভিন্ন অংশ বাঁশ ও বালুর বাঁধ দিয়ে দখল করে রাখা হয়েছে। কিছু অংশে নির্মাণ করা হয়েছে স্থাপনা। অনেক জায়গায় খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) ও জেলা প্রশাসনের যৌথ জরিপের পর স্থাপনা করা সীমানা খুঁটি তুলে ফেলা হয়েছে। এতে মূল নদীর জায়গা ছোট হয়ে গেছে। দখল করা জায়গায় করা যাচ্ছে না খনন।

দেখা গেছে, খননের দ্বিতীয় সেকশনের ত্রিমোহনা এলাকায় পরামর্শক সংস্থার নকশায় নদী রয়েছে ৪২ মিটার প্রশস্ত। ওই অংশে ৪২ মিটারই খননের কথা বলা হয়েছে। তবে বাস্তবে ওই স্থানে নদী রয়েছে ২৬ মিটার। বাকি ১৬ মিটার জায়গায় বাড়িঘর ও গাছগাছালি। ফলে ২৬ মিটার খনন করেই কাজ শেষ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। নদীর সীমানা নির্ধারণ না হওয়ায় বাকি অংশ আর খনন হয়নি। এ অবস্থায় ফের নদীর সীমানা জরিপের কাজ শুরু করেছে কেসিসি ও জেলা প্রশাসন। গত সোমবার কেসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লস্কর তাজুল ইসলাম জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়ে সীমানা নির্ধারণ ও খননকাজে সহযোগিতার অনুরোধ জানিয়েছেন। এদিকে ময়ূর নদীতে পেড়ি ও নরম মাটি বেশি থাকায় খননকাজে কাঙ্ক্ষিত গতি আসছে না। নরম মাটি বেশি থাকায় শশ্মান ঘাটের কাছে একটি সড়ক ধসে পড়েছে।

কেসিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান মেয়রের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অন্যতম ছিল জলাবদ্ধতা নিরসন। মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার আগেই ৮২৩ কোটি টাকার ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন’ প্রকল্প অনুমোদন হয়। এই প্রকল্পের আওতায় নদী খনন হচ্ছে। খননকাজ শুরু করতে ২০২২ সালের ৭ জুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আমিন অ্যান্ড কোং অ্যান্ড শহীদ এন্টারপ্রাইজকে কার্যাদেশ দেয় কেসিসি। তাদের চুক্তিমূল্য ৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। বর্ষার কারণে নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৬ মাস পর শুরু হয় কাজ।

প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জানা গেছে, বয়রা শ্মশান ঘাটের ৮০ মিটার উজান থেকে সাচিবুনিয়া ব্রিজের ১০০ মিটার পূর্ব পর্যন্ত মোট ৫ হাজার ৯১০ মিটার নদী কাটা হবে। গড়ে ২ থেকে ৭ ফুট পর্যন্ত নদী খনন করা হবে। ময়ূর নদী বর্তমানে ৬৬ থেকে ১৪৪ ফুট পর্যন্ত চওড়া রয়েছে। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী নদীর ৮৫ শতাংশ শক্ত মাটি ৫০০ মিটার দূরে এবং ১৫ শতাংশ নরম পেড়িমাটি ৫ কিলোমিটার দূরে রাখার কথা রয়েছে। শক্ত মাটির ৭৫ শতাংশ কাটা হবে ভেকু দিয়ে। আর ১০ শতাংশ কাটা হবে শ্রমিক দিয়ে।

সরেজমিন দেখা গেছে, শ্মশানঘাট ব্রিজের এ পাড় থেকে নদীর প্রায় এক কিলোমিটার অংশ খনন করা হয়েছে। বাঁধ দিয়ে পানি শুকিয়ে ভেকুর সাহায্যে নদীর মাটি কাটা হচ্ছে। এ কারণে খননকাজের পুরোটাই দৃশ্যমান। শুরু থেকে নদীর প্রশস্ততা ঠিক থাকলেও ত্রিমোহনা এলাকায় এসে নদী সরু হয়ে গেছে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ত্রিমোহনার নতুন মসজিদের সামনে পরামর্শক সংস্থার নকশায় নদীর প্রশস্ততা ৪২ মিটার উল্লেখ রয়েছে। তবে ২৬ মিটার কাটার পরে দু’পাশে বাড়িঘর পড়েছে। বাকি অংশ না কেটেই খননকাজ সামনে এগিয়ে গেছে।

ত্রিমোহনার সামনে একাধিক স্থানে বাঁশের বাঁধ দিয়ে নদীর জায়গা দখল করে বালু ফেলতে দেখা গেছে। মাহাতাব উদ্দিন সড়কের মাথায়, নদীর অর্ধেকটাজুড়ে বাঁশের বেড়া দিতে দেখা গেছে। ওই অংশে কেসিসির সীমানা খুঁটি তুলে ফেলা হয়েছে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান আমিন আহমেদ সমকালকে বলেন, নদীর সীমানা যেটুকু ফাঁকা রয়েছে সেই অংশে নদী খনন হচ্ছে। বাকি অংশে মানুষের ঘরবাড়ি কাটতে গেলেই তারা তেড়ে আসে। এখন কেসিসি নদীর সীমানা চূড়ান্ত এবং স্থাপনা উচ্ছেদ করে বুঝিয়ে না দিলে বাকি অংশ কাটা কষ্টকর।

তিনি বলেন, নদীতে পেড়ি ও নরম মাটি বেশি। এ ছাড়া পাড়জুড়ে অবৈধ দখলদার। নদীতে খনন যন্ত্র আনা–নেওয়ার জায়গা নেই। এগুলোই খননকাজে প্রধান অন্তরায়।

কেসিসির জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরিচালক ও কেসিসির প্রধান প্রকৌশলী মনজুরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, কেসিসিতে যত কাজ চলে এর মধ্যে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ময়ূর নদী খনন। দেশে অন্য কোথাও বাঁধ দিয়ে নদী শুকিয়ে মাটি কাটা হয় না। এ জন্য কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। এগুলো সমাধানের কাজ চলছে। গত সপ্তাহে নদীর এক অংশের সীমানা মাপা হয়েছে। প্রয়োজনে বাকি অংশ পরে কাটা হবে।

কেসিসি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক বলেন, নদী খননকাজে গাফিলতি বা বাধা সহ্য করা হবে না। নকশা অনুযায়ী নদী খনন করে আমাকে দেখিয়ে দিতে হবে। এরপর বিল পরিশোধ করা হবে।

বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ জামান বলেন, একবার খননের টাকা পানিতে গেছে। এ জন্য দ্বিতীয়বার খননের আগে নদীর সীমানা চিহ্নিত করে কাজ শুরু করা উচিত ছিল। সীমানা নির্ধারণ করে সব পক্ষকে নিয়ে সঠিকভাবে কাজ করতে হবে। না হলে এবারও সুফল নিয়ে সংশয় দেখা দেবে।