
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে শনিবার অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণের পর উদ্ধার তৎপরতা। হতাহতের খবরে অসংখ্য মানুষ ভিড় জমায় ঘটনাস্থলে। এ সময় অনেককে আহাজারি করতে দেখা যায় - সমকাল
৪ জুন ২০২২ থেকে ৪ মার্চ ২০২৩। মাঝে ৯ মাস। এর মধ্যেই বিস্ফোরণে ফের কাঁপল চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড। আবারও রক্তে ভিজল এ জনপদ। বিএম ডিপোর ভয়াবহতার ক্ষত মন থেকে না মুছতেই এবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে সীতাকুণ্ডের কদমরসুল (কেশবপুর) এলাকার সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেডের প্লান্টে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল। এ ঘটনায় গত রাত দেড়টায় প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত ৩০ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে দগ্ধ ১১ জন বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছেন। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। রাতে উদ্ধার অভিযান সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে। আজ সকাল থেকে ফের উদ্ধার তৎপরতা শুরু হবে। এ ঘটনায় সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন।
এদিকে প্লান্টের চারপাশে বিপজ্জনকভাবে এখনও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শতাধিক অক্সিজেন সিলিন্ডার। এগুলোর নিচে লাশ থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন উদ্ধারকারীরা। দুর্ঘটনার সময় প্লান্টটিতে ৩০ থেকে ৪০ জন কর্মরত ছিলেন বলে জানিয়েছেন আহত এক শ্রমিক। তবে গতকাল রাত পর্যন্ত সীমা অক্সিজেন প্লান্টের দায়িত্বশীল কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ঘটনার পরপরই সটকে পড়েছেন তাঁরা।
গতকাল বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে এই বিস্ফোরণের পর ফায়ার সার্ভিসের আগ্রাবাদ, কুমিরা ও সীতাকুণ্ডের ৯টি ইউনিট দুই ঘণ্টার তৎপরতায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় ছুটে যান সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ, নৌবাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা। এ ঘটনায় আশপাশের দুই কিলোমিটার এলাকা কেঁপে ওঠে। বহু কারখানা ও ঘরবাড়ির জানালার কাচ ভেঙে যায়। বিস্ফোরণের ভয়াবহতা এত বেশি ছিল, প্লান্টের ভেতরে থাকা টিনের শেড বহু দূরে উড়ে আছড়ে পড়ে। দুটি ট্রাক পুড়ে গেছে। বিস্ফোরণের পর লম্বা কয়েকশ অক্সিজেন সিলিন্ডার প্লান্টের ভেতর পড়ে থাকতে দেখা যায়। এ কারণে উদ্ধার অভিযান চালাতে ফায়ার সার্ভিসকে বেগ পেতে হয়।
বিস্ফোরণে অক্সিজেন প্লান্টের পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশের তিনটি কারখানার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্লান্টের পাশে থাকা তিন তলা একটি ভবনে আগুন ধরে যায়। প্লান্টের ২০০ গজের মধ্যে একজনের হাতের কবজি পড়ে থাকতে দেখা গেছে। বের হয়ে গেছে অনেকের নাড়িভুঁড়ি। আতঙ্কে এ এলাকার আশপাশের বাসিন্দারা অন্যত্র নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছেন।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেন, আহতদের বেশিরভাগই আঘাত পেয়েছেন। তাঁদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। দু’জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। হাসপাতালে পর্যাপ্ত রক্ত, স্যালাইন ও ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নিহত যাঁরা: নিহত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনের লাশ কারখানার ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়। তাঁরা হলেন– সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট বাংলাবাজার এলাকার বাসিন্দা ফরিদ (৩৪), সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকার শামসুল আলম (৬৫), নেত্রকোনার কলমাকান্দার ছোট মনগড়া গ্রামের রতন লখরেট (৪৫), নোয়াখালীর সুধারামের অলিপুর গ্রামের আবদুল কাদের (৫০) ও লক্ষ্মীপুরের মো. সালাউদ্দিন। একজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
চমেক হাসপাতালে যাঁদের ভর্তি করা হয়েছে তাঁরা হলেন– ফোরকান (৩৩), নুর হোসেন (৩০), মোতালেব (৫২), আরাফাত (২২), মাকসুদুল আলম (৬০), ওসমান (৪৫), সোলায়মান (৪০), রিপন (৪০), আজাদ (২২), রিপন (৬০), নারায়ণ ধর (৬৪), জসিম (৫০), ফেন্সী (২৬), জাহেদ (৩০), মুবিবুল হক (৪৫), রোজি বেগম (২০) ও মাহিন শাহরিয়ার (২৬)।
৫০০ গজ দূরে একজনের মৃত্যু: চট্টগ্রাম সিটি গেট থেকে ৭ কিলোমিটার উত্তরে সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামে সীমা অক্সিজেন প্লান্টের অবস্থান। কারখানাটির উত্তরে সেই বিএম কনটেইনার ডিপোর আশপাশে বাস করেন কয়েক হাজার লোক। প্লান্টের অদূরে এক দোকানে চা খাচ্ছিলেন কদমরসুল এলাকার বাসিন্দা শামসুল আলম। বিস্ফোরণের পরপরই সেখানে লোহার টুকরা এসে পড়ে তাঁর মাথার ওপর। গুরুতর আহত অবস্থায় চমেক হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। শামসুলের বড় ভাই ওবায়দুর মোস্তফা জানান, ঘটনাস্থল থেকে ৫০০ গজ দূরে চা দোকানে শামসুল বসেছিলেন। ২৫০ থেকে ৩০০ কেজি ওজনের একটা লোহার টুকরা দোকানের ওপর এসে পড়ে। এ সময় শামসুল মাথায় আঘাত পেলে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। পরে হাসপাতালে মারা যান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বলছেন: বিস্ফোরণে হঠাৎ কেঁপে ওঠে আশপাশের দুই বর্গকিলোমিটার এলাকা। ঘটনাস্থলের এক কিলোমিটারের মধ্যে ইনফিনিয়া নামে একটি তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে। বিস্ফোরণে ওই কারখানার জানালার কাচ ভেঙে যায়। কারখানার শ্রমিক রোকেয়া বেগম জানালার পাশে বসে কাজ করছিলেন। হঠাৎ শব্দে জানালার কাচ ভেঙে তাঁর শরীরের ওপর পড়ে। তিনি বলেন, বিকট শব্দে তিনি ভড়কে যান। অল্পের জন্য তিনি জানালার ভাঙা কাচের আঘাত থেকে নিজেকে রক্ষা করেন। শ্রমিক হালিম বলেন, আমি পাশের দোকানে নাশতা করতে অফিস থেকে বের হয়েছি। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পাই। আমার আশপাশের লোকজন দৌড়ে পালিয়ে যান।
ভাটিয়ারী ইউপির চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দিন জানান, বিস্ফোরণের পর তিনি ঘটনাস্থল থেকে আহত চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন।
মাদামবিবির হাটের বাসিন্দা রিদওয়ানুল হক বলেন, বিস্ফোরণের পর কদমরসুল এলাকায় কালো ধোঁয়া ওপরের দিকে উঠতে দেখি। ধোঁয়া অনুসরণ করে কারখানা এলাকায় গিয়ে দেখেন, বীভৎস অবস্থা। একের পর এক আহত শ্রমিকদের বের করে আনা হচ্ছে।
বিস্ফোরণের কারণ: কারখানায় কী কারণে বিস্ফোরণ ঘটেছে তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। স্থানীয় প্রশাসনও অন্ধকারে রয়েছে। সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন কর্মকর্তা নুরুল আলম দুলাল বলেন, কী কারণে বিস্ফোরণ হয়েছে, তা এখন বলা সম্ভব নয়। কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ বলেন, কীভাবে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তদন্ত করার পরই বলা যাবে কেন বিস্ফোরণ ঘটেছে।
পুরো এলাকা অন্ধকারে: বিস্ফোরণের পর অধিকাংশ বিদ্যুতের খুঁটির লাইন ছিঁড়ে গেছে। ফলে বিচ্ছিন্ন রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। বন্ধ হয়ে গেছে স্থানীয় অনেক কারখানা।
ফৌজদারহাট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান নির্বাহী শেখ কাউছার মাসুম বলেন, বিকট বিস্ফোরণের পর বিদ্যুতের অটো লাইন বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক পুল হেলে পড়েছে। পুলের ইনসুলেটরও নষ্ট হয়ে গেছে। বিদ্যুতের লাইন ঠিক করতে চার-পাঁচ দিন লাগতে পারে। তবে বিদ্যুতের ক্ষতির পরিমাণ তদন্ত করে জানা যাবে।
সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি: বিস্ফোরণের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান চট্টগ্রাম সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানসহ প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা। জেলা প্রশাসক নিহত প্রতি পরিবারের স্বজনকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দেন। এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে প্রধান করে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। কমিটিকে পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, কারখানা মালিকদের অসতর্কতার কারণে বারবার এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। সঠিক কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা না হলে এ দুর্ঘটনা ঠেকানো সম্ভব নয়।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, যাঁরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাঁদের ওষুধ কেনার জন্য জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চমেক হাসপাতালে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। তিনি জানান, সীতাকুণ্ডে দুই মাসে ৯টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে।
এদিকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে নিহতদের দাফনের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে ও পরিবারের সদস্যদের ২ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। এ ছাড়া আহত প্রত্যেকে পাবেন ৫০ হাজার টাকা।
লাইসেন্স নিয়ে ধোঁয়াশা: গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা ১৯৯১ অনুযায়ী অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপন করতে হলে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্স নিতে হয়। তবে সীমা অক্সিজেনের লাইসেন্স নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা।
এ প্রসঙ্গে বিস্ফোরক পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন সমকালকে বলেন, সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেডের লাইসেন্স রয়েছে। তবে লাইসেন্স নবায়ন করেছে কিনা তা জানা নেই।
সর্বশেষ তাঁরা কবে কারখানাটি পরিদর্শন করেছিলেন তাও জানাতে পারেননি তিনি। বলেছেন, অনেক আগে একবার পরিদর্শন করা হয়েছে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপমহাপরিদর্শক আব্দুল্লাহ আল সাকিব মুবাররাত প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদন আছে কিনা বা সর্বশেষ কবে পরিদর্শন করা হয়েছিল এর তাৎক্ষণিক কোনো তথ্য দিতে পারেননি। রোববার অফিসে গিয়ে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দেখবেন বলেছেন।
মন্তব্য করুন