বাংলাদেশ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) নিয়ন্ত্রণাধীন যমুনা সার কারখানা ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি চাঁদাবাজ চক্র। তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন ডিলার ও ট্রাকচালকরা। প্রতিদিন সার উত্তোলনের সময় ডিলারদের কাছ থেকে ঘাটে ঘাটে চাঁদা আদায় করছেন চক্রের সদস্যরা। এর প্রভাব পড়ছে প্রান্তিক কৃষকের ওপর।

যমুনা ইউরিয়া সার কারখানা থেকে দেশের ১৯ জেলায় বিসিআইসির নিবন্ধিত ১ হাজার ৮০০ ডিলারের মধ্যে প্রতি মাসে সার সরবরাহ করা হয়। পরে প্রান্তিক কৃষকের মধ্যে সরকার নির্ধারিত মূল্যে সার বিক্রি করেন তাঁরা।

ভুক্তভোগী ডিলারদের অভিযোগ, প্রথম কিস্তিতে কারখানার ভেতরে প্রতিদিন ট্রাকপ্রতি ২০০ ও বহিরাগত ট্রাকচালকদের কাছ থেকে ৩০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। এ টাকা আদায় করেন সার লোডিং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জাহাঙ্গীর এন্টারপ্রাইজের শ্রমিক সর্দার ও পোগলদিঘা ইউপি সদস্য মোফাজ্জল ও তাঁর ভাই তোফাজ্জল। এরপর দ্বিতীয় কিস্তিতে ডিলার বা প্রতিনিধিদের কাছ থেকে ট্রাকপ্রতি ৩৫০ টাকা আদায় করেন তাঁরা। তৃতীয় কিস্তিতে স্থানীয় সার ডিলারের কাছ থেকে বস্তাপ্রতি ১ টাকা ও অন্য জেলার ডিলার বা প্রতিনিধির কাছ থেকে দেড় টাকা চাঁদা আদায় করে তারাকান্দি ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতি। তাদের কর্মচারী চাঁন মিয়ার মাধ্যমে এ টাকা আদায় করা হয়।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে যমুনা সার কারখানা থেকে ডিলারদের বরাদ্দ দেওয়া হয় ৪৫ হাজার টন ইউরিয়া। এসব সার প্রতিদিন ট্রাকে করে এলাকায় নিয়ে যান ডিলাররা। তারাকান্দি ট্রাক ও ট্যাঙ্কলরি মালিক সমিতি জানায়, ফেব্রুয়ারিতে প্রতিদিন কারখানায় ১২০ থেকে ১২৫টি ট্রাক ভর্তি করা হয়। এ হিসাবে কারখানা ফটক থেকে ডিলারদের কাছ থেকে প্রতিদিন গড়ে চাঁদা আদায় হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। যা মাসে দাঁড়ায় ৩৩ লাখ টাকা।

স্থানীয় সার ব্যবসায়ীরা জানান, এই চাঁদার পরিমাণ কম-বেশি নির্ভর করে বরাদ্দের ওপর। যে মাসে বরাদ্দ বেশি আসে, সেই মাসে চাঁদার পরিমাণও বাড়ে। সাবেক এক ঠিকাদার বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছর সার লোডিংয়ের দরপত্রের মূল্য ছিল ১ কোটি ১৯ লাখ টাকা। কিন্তু রমরমা চাঁদাবাজির কারণে চলতি অর্থবছরে সেই কাজ মাত্র ১৬ লাখ টাকায় বাগিয়ে নেয় মেসার্স জাহাঙ্গীর এন্টারপ্রাইজ।  

একাধিক ডিলার বলেন, চাঁদা দিতে না চাইলে ট্রাকচালক ও ডিলারের প্রতিনিধিদের গালাগাল করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন। টাকা না পেলে ট্রাক ভর্তি করা থেকে বিরত থাকে। এমনকি ছেঁড়া-ফাটা ও ওজনে কম বস্তা দিয়ে তাঁদের হয়রানি করা হয়। একাধিক ট্রাক মালিক জানান, চালকদের কাছ থেকে যে চাঁদা আদায় করা হয়, দিন শেষে তা সার ডিলারদের কাঁধেই পড়ে।

ডিলারদের পক্ষ থেকে জেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সভাপতি এবং জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন হাফিজুর রহমান ও ইকরামুল হক নামে দুই ব্যক্তি। তাঁদের অভিযোগ, মেসার্স জাহাঙ্গীর এন্টারপ্রাইজের মালিক ফরহাদ হোসেন। তবে এ প্রতিষ্ঠানের সাব কার্যক্রম পরিচালনা করেন তাঁর শ্যালক সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম রফিক। এ অস্বাভাবিক চাঁদার কারণে সরকার নির্ধারিত মূল্যে সার বিক্রি করতে গিয়ে ডিলারদের লোকসান গুনতে হয়। তাই অনেক ডিলার কারখানা ফটকেই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে সার বিক্রি করে দেন। যাঁরা এলাকায় সার নিয়ে যান, তাঁরা খরচ পোষাতে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন।

তারাকান্দি ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতির সভাপতি বেলাল হোসেনের ভাষ্য, ট্রান্সপোর্টের (পরিবহন) নামে ডিলারদের কাছ থেকে যত টাকা নেওয়া হয়, তাঁরা সে পরিমাণ টাকা পান না। ট্রান্সপোর্টের নামে টাকা তুলে এর স্বাদ নিচ্ছেন লোডিং ঠিকাদারের পরিচালক রফিক। এ টাকার ভাগবাটোয়ারা যায় কারখানার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজনের পকেটে।

মেসার্স জাহাঙ্গীর এন্টারপ্রাইজের পরিচালক রফিকুল ইসলাম রফিক সমকালকে বলেন, ‘ডিলার ও ট্রাকচালকদের কাছ থেকে যে টাকা নেওয়া হয় তা চাঁদা নয়, লেবার বকশিশ।’ মাত্র ১৬ লাখ টাকায় লোডিং ঠিকাদারি কেন নিলেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যমুনায় আগে যাদের আধিপত্য ছিল, তারা কারখানাকে এককভাবে লুটপাট করেছে। সংসদ সদস্য ডা. মুরাদ হাসানের যখন আধিপত্য ছিল, তখন অন্য কোনো ঠিকাদার শিডিউলই (দরপত্র) কিনতে পারেননি। আর এখন প্রতিটি কাজই নিতে হয় প্রতিযোগিতা করে। এতে সরকারি রাজস্বও সাশ্রয় হচ্ছে।’

কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদুল্লাহ খানের দাবি, প্রতি বছর ট্রাক লোডিংয়ের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দেয় কারখানা কর্তৃপক্ষ। ডিলারদের মধ্যে সার সরবরাহ করতে লোডিং ঠিকাদারের যাবতীয় খরচ কারখানা কর্তৃপক্ষই বহন করে। এক্ষেত্রে ডিলারদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়ার নিয়ম নেই। চাঁদা আদায়ের ব্যাপারে তিনি জানান, বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তারপরও যদি কেউ টাকাপয়সা নিয়ে থাকে, তাঁর সঙ্গে কারখানা কর্তৃপক্ষের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।