- সারাদেশ
- বর্জ্যে সর্বনাশ কৃষিজমির
বর্জ্যে সর্বনাশ কৃষিজমির

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মকশ বিলের পশ্চিম চকে প্রায় দেড় বিঘা বোরো ধানের জমি রয়েছে শফিকুল উদ্দিনের। তাঁর বাড়ি বিললাগোয়া কৌচাকুড়ি এলাকায়। কয়েক বছর ধরে সব সময় তাঁর জমি থাকে বর্জ্যমিশ্রিত পানির তলায়। যে কারণে ধানচাষ করতে পারছেন না। এর জন্য আশপাশের শিল্পকারখানাকে দায়ী করেন তিনি।
শফিকুলের ভাষ্য, মকশ বিলে প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে আগে বোরো ধান চাষ হতো। সাম্প্রতিক সময়ে বেশিরভাগ জমি আবাদের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। কারখানা থেকে ফেলা অপরিশোধিত বর্জ্য তীব্র দুর্গন্ধ ছড়ায়। যে কারণে আশপাশের লোকজন শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে ভুগছে। পানি ব্যবহার করলে চুলকানিসহ চর্মরোগ ছড়িয়ে পড়ে।
কৃষকরা জানান, মকশ বিলের পানি দূষিত হয়ে পড়ায় তাঁরা জমিতে ব্যবহার করতে পারেন না। যে কারণে আশপাশের মাটিকাটা, কৌচাকুড়ি, সিনাবহ, মাঝুখান, রতনপুর, আত্রমচালা, বাঁশতলী এলাকার চাষিরা আবাদ বন্ধ করে দিয়েছেন।
এই বিলে মাছ ধরেই সংসার খরচ চালাতেন গোবিন্দপুরের জেলে রাজবংশী বদন। তবে সম্প্রতি ওই বিলে মাছ ধরা কঠিন হয়ে পড়ে তাঁর। রাজবংশী বলেন, পুরো বিলে ছড়িয়ে পড়েছে বিষাক্ত বর্জ্য। তবে পশ্চিম পাশের অবস্থা খুব খারাপ। যে কারণে শুকনো মৌসুমে মাছ ধরতে পারেন না। বর্ষায় পানি বাড়লে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। তবে সারা বছর ওই বিলসহ আশপাশের খালগুলোতে নামলে শরীর চুলকায়, ফোস্কা পড়ে যায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার পল্লীবিদ্যুৎ এলাকায় ডিভাইন টেক্সটাইল, ইকোটেক্স লিমিটেড, সাত্তার টেক্সটাইল, হরিণহাটি এলাকায় এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড, সফিপুর এলাকায় রহিম টেক্সটাইল মিলস, সামছুদ্দিন স্পিনিং, এস এম শাহাবুদ্দিন স্পিনিং অ্যান্ড ডাইং লিমিটেড, সুরিচালার ডাইং কারখানা, মৌচাক এলাকার সাদমা ডাইং কারখানা, পূর্ব চান্দরার আইমন টেক্সটাইল, এপেক্স ল্যান্ডজারি লিমিটেডসহ অর্ধশতাধিক কারখানায় অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি গিয়ে পড়ে মকশ বিলে। একটি সূত্র জানায়, ওই কারখানাগুলোর বেশিরভাগে বর্জ্য শোধনাগার বা ইফলুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) রয়েছে। তবে খরচ বাঁচাতে সেগুলো মাসের পর মাস বন্ধ রাখা হয়। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের তেমন তদারকি নেই। কারখানাগুলোর কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে কথা বলতে চাননি।
স্থানীয় কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি কারখানায় ইটিপি স্থাপন বাধ্যতামূলক। অথচ কালিয়াকৈরের অন্তত দেড়শ কারখানায় ইটিপি নেই। অল্পসংখ্যক কারখানায় তা থাকলেও কর্তৃপক্ষ খরচ কমাতে অধিকাংশ সময় তা বন্ধ রাখে।
কালিয়াকৈর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ইটিপি ব্যবহার না করায় কারখানার বর্জ্য-পানি সরাসরি খালে ফেলা হচ্ছে। যা নিচু খালবিলে বা ফসলি জমিতে পড়ছে। এতে উর্বরতা হারাচ্ছে মাটি, নষ্ট হচ্ছে ফসল। মাছ কমছে। ইটিপি চালু করতে বারবার কারখানাগুলোকে তাগিদ দেওয়া হলেও তা শুনছে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) গাজীপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক হাসান ইউসুফ খান মনে করেন, পরিবেশের এমন বিপর্যয় রোধ করাই পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রধান কাজ। অথচ নানা জটিলতা দেখিয়ে কর্মকর্তারা এ বিষয়গুলো এড়িয়ে যান। গাজীপুরের অধিকাংশ কারখানায় ইটিপি নেই। কোনো কারখানায় নেই, কোনোটায় থাকলেও নিয়মিত চালু হয় না– এসব তদারকি করা উচিত পরিবেশ অধিদপ্তরের। কর্মকর্তারা বছরে একবার অভিযান চালান। তবে অজ্ঞাত কারণে এর ধারাবাহিকতা নেই। ফলে দূষিত বর্জ্যে পরিবেশের সর্বনাশ ঘটছে। মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ বলেন, যেসব কারখানায় ইটিপি নেই, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত অভিযান চালাবেন।
গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নয়ন মিয়া দাবি করেন, যেসব কারখানায় নিয়মিত ইটিপি চালু করা হয় না, তাঁদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ওই কারখানাতেও অভিযান চালাবেন। প্রয়োজনে কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে সুপারিশ করবেন।
মন্তব্য করুন