চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণে গুরুতর আহত ১৮ শ্রমিক বেঁচে ফিরলেও বাকি জীবনটা কাটবে যন্ত্রণায়। বধির হয়ে যাওয়া, দৃষ্টিশক্তি হারানোর পর সুস্থ জীবনে ফেরা কঠিন হয়ে উঠেছে তাঁদের। বিস্ফোরণে আঘাত পেয়ে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন তিন শ্রমিক। এ ছাড়া বেশিরভাগই হারিয়েছেন শ্রবণশক্তি। মস্তিষ্কে আঘাত পাওয়ায় আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন দু’জন। মৃত সালাহ উদ্দিন নামে একজনের লাশ নিতে দুই স্ত্রী হাজির হওয়ায় গতকাল রোববার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ঘটে লঙ্কাকাণ্ড।

আইসিইউ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. হারুন অর রশীদ বলেন, চিকিৎসাধীন দু’জনের মধ্যে প্রবেশ লালের অবস্থা বেশি খারাপ। মাথায় অস্ত্রোপচারের পর তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। অন্যজন মাসুদুল আলমের ডান পা বিস্ফোরণে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। তাঁর অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা ভালো।

স্ত্রী-সন্তানের আর্তনাদ: প্রবেশ লাল শর্মা ২২ বছর ধরে সিনিয়র অপারেটর পদে কাজ করছেন। বিস্ফোরণের আঘাতে মুহূর্তেই ছিটকে পড়েন প্রবেশ। পুরো মাথা ও মস্তিষ্ক প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথমে হাসপাতালের নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হলেও অবস্থার অবনতি হতেই স্থানান্তর করা হয় আইসিইউতে। এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন তিনি। প্রবেশ লাল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ছেলে এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী আর মেয়ে পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। স্বামীর এমন মরমর পরিস্থিতিতে স্ত্রী সীমা শর্মা দিশেহারা।

গতকাল আইসিইউ বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, বিভাগের প্রধান ফটকের বাঁ পাশেই অনেকটা অচেতন পড়ে আছেন তিনি। কিছুক্ষণ পর পর মূর্ছা যাচ্ছেন। দুই চোখে বইছে জলধারা। ভাটিয়ারিতে ভাড়া বাসায় পরিবারসহ প্রবেশ লাল শর্মা বাস করেন। মাসিক ২৬ হাজার টাকা বেতনে কোনোভাবে চলে সংসার। এ পরিস্থিতিতে আগামী দিনগুলো কীভাবে কাটবে তা নিয়ে সন্দিহান সীমা শর্মা।

অধিকাংশেরই শ্রবণশক্তি কমেছে: চমেক হাসপাতালের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি নূর হোসেন। তাঁর পাশে বসে থাকা স্ত্রী আয়েশা আক্তার নূর হোসেনকে খাবার খেতে ঢাকছেন। তবে তা শুনছেন না নূর। পরে শরীরে হাত দিয়ে ডাক দিলে খাবার খাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন তিনি। বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজে শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন তিনি। শুধু তিনি নন, তাঁর মতো প্লান্টের অপারেটর ওসমান বিস্ফোরণে তাঁর দুই পায়ের গোড়ালিতে লোহার ছোট ছোট টুকরা ঢুকায় ভর্তি হাসপাতালে। তাঁরও শ্রবণশক্তি কমেছে। ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি ফিলিংম্যান আবদুল মোতালেব, অপারেটর রিপন মারাকও কানে কিছুই শুনছেন না। প্লান্টের প্রধান হিসাবরক্ষক নওশাদ সেলিম, আরাফা, সোলায়মান, নারায়ণ, জসিম,  মুবিবুল হক সবার শুনতে সমস্যা হচ্ছে। ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে কর্তব্যরত চিকিৎসক মো. ফিরোজ বলেন, বিস্ফোরণের বিকট শব্দে বহু শ্রমিকের কানে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।

দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন তিন শ্রমিক: আহত অধিকাংশ শ্রমিকের শ্রবণশক্তি কমে গেলেও ছিটকে আসা ভারী বস্তুর আঘাতে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন তিন শ্রমিক। তাঁদেরই একজন মো. আজাদ। রোববার তাঁর চোখে অস্ত্রোপচার হয়। তিনি এক চোখে আর দেখতে পাবেন না। বাঁ চোখের অবস্থাও খারাপ। দুর্ঘটনায় তাঁর মুখমণ্ডল থেতলে গেছে। তাঁর মতো আরেক শ্রমিক নাহিন শাহরিয়ারের বাঁ চোখে কাচ ঢুকে নার্ভ কেটে গেছে। অস্ত্রোপচার করে অনেক কাচ বের করা হয়। তবে তাঁর চোখটি ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কম। সোলায়মানের দুই চোখেই কাচ ও লোহার টুকরা ঢুকেছে। তাঁরও একটি চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে।

চমেক চক্ষু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক তনুজা তানজিন বলেন, দুর্ঘটনায় আহত তিনজনের একটি করে চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। আমার চেষ্টা করছি, তবে তাঁদের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা কম।

লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর: বিস্ফোরণে নিহত ছয়জনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে রোববার সন্ধ্যার মধ্যে চমেক মর্গ থেকে লাশ হস্তান্তর করে প্রশাসন। ঘটনার দিন ছয়জনের মধ্যে একজনের পরিচয় শনাক্ত না হলেও গতকাল পরনের শার্ট দেখে সেই ‘অচেনা’ সেলিম রিচিলের লাশ শনাক্ত করেন তাঁর স্ত্রী।

চমেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত জেলা পুলিশের এএসআই আলাউদ্দীন তালুকদার বলেন, নিহত ছয়জনের পরিচয় শনাক্ত হওয়ার পর ময়নাতদন্তসহ অন্যান্য কাজ শেষ করে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।