বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত প্রায় দুই শতক জমিতে চাষ করছেন লালশাক, পালংশাক, বাঁধাকপি, টমেটো, মিষ্টিকুমড়াসহ কয়েক ধরনের শাকসবজি। বাড়ির সামনে দুটি রিংয়ে ভার্মি কম্পোস্ট সার। ভেতরে কবুতর আর মুরগির খাঁচা। উঠানে ১১ নারী বসেছেন নিজ হাতে ডিজাইন ও সেলাই করা জামাকাপড় নিয়ে। কেউ পছন্দ করছেন, কেউ বা দরদাম করছেন। এ দৃশ্য দেখা গেল দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ছোট খোদাদপুর এলাকার ফারজানা বেগমের বাড়িতে। তিনি ওই এলাকার সিরাজুল ইসলামের স্ত্রী।

সিরাজুল ইসলাম কৃষিকাজ ও গরু কেনাবেচার ব্যবসা করেন। তাঁর একার আয়ে সংসারে টানাপোড়েন লেগেই থাকত। অভাবের সংসারে স্বামীকে সহায়তা করতে শুরু করেন ফারজানা। এখন তাঁর বাড়িতে ১৭টি মুরগি, তিনটি হাঁস, তিনটি গরু ও দুটি ভার্মি কম্পোস্ট সারের রিং রয়েছে। আছে দুটি সেলাই মেশিনও। ফারজানা জানান, এখন সব মিলিয়ে তিনি মাসে অন্তত ১০ হাজার টাকা উপার্জন করেন। বাড়তি আয়ে চলতি বছরে তাঁরা দুই বিঘা জমি কিনেছেন। সেই জমি থেকে এবার ৪৭ মণ ধান পেয়েছেন। অথচ একটা সময় ফারজানার সংসার চালানোই ছিল দায়।   

ফারজানা বলেন, ‘স্বামীকে সহযোগিতা করতে একশনএইড থেকে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ নিয়ে আমি এসব কাজ শুরু করি। শাকসবজি উৎপাদনের জন্য সব ধরনের বীজ একশনএইড অফিস থেকেই দেওয়া হয়। ডিম, দুধ, হাঁস-মুরগি, শাকসবজি ও ভার্মি কম্পোস্ট সার বিক্রিতে তারা সহযোগিতাও করে।’ তিনি আরও জানান, তিনি যে সবজি আবাদ করেন, তা সম্পূর্ণ বিষ ও রাসায়নিকমুক্ত। নিমপাতার রস দিয়ে পোকামাকড় দূর করে ভার্মি কম্পোস্ট সার ব্যবহার করেন। জলবায়ু প্রকল্প থেকেই আমাদের বীজ ও স্প্রে মেশিন দেওয়া হয়। বীজ বপন, রোপণ ও বিক্রিতে নারীরা যুক্ত থাকছে।

ফারজানার মতোই ওই গ্রামের ২৩ নারী এখন স্বাবলম্বী হয়ে সংসারে বিশেষ ভূমিকা রাখছেন। শহীদুল ইসলামের স্ত্রী রত্না বেগম বাড়ির আনাচে-কানাচে পরিত্যক্ত এক শতক জমিতে শাকসবজি আবাদ করেছেন। কেঁচো কম্পোস্ট সার উৎপাদন শুরু করেছেন। তিনটি গরু কিনেছেন। রয়েছে কয়েকটি মুরগিও। আতিয়ার রহমানের স্ত্রী শিউলি খাতুন দুই শতক জমিতে শাকসবজি আবাদ করেছেন। চারটি গরু রয়েছে তাঁর, এর মধ্যে একটি দুধ দেয় দেড় কেজি করে। ছাগল রয়েছে দুটি, কবুতর রয়েছে ১৫টি ও একটি রিং ভার্মি কম্পোস্ট রয়েছে।

ওই গ্রামে বাড়ি রয়েছে ৭৮টি। এর মধ্যে ২৩টি পরিবারের নারীই স্বাবলম্বী হয়েছেন বাড়িতে বিভিন্ন কাজ করার মাধ্যমে। তাঁদের উপার্জন এখন সংসারে অবদান রাখছে। তবে অজপাড়াগাঁয়ে এই অবস্থা বছরদুয়েক আগেও ছিল না। ওই গ্রামের নারীদের সাফল্যের পেছনে রয়েছে ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং জীবিকা নির্বাহে নারীর নেতৃত্বে সমাধান প্রকল্প’। একশনএইড বাংলাদেশের প্রকল্পটি শুরু হয়েছে ২০২২ সালের জুলাই মাসে। এর মূল উদ্দেশ্য গৃহস্থালিতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও জীবিকা নির্বাহের জন্য নারীদের নেতৃত্বে টেকসই কৃষি উৎপাদন শুরু করা, কৃষি বাজারে নারীর প্রবেশাধিকার উন্নত করা এবং মাঠপর্যায়ে জাতীয় কৃষিনীতি-২০১৮ বাস্তবায়নের দাবিতে নারীদের সংবেদনশীল করা।

এ প্রকল্পের অধীনে ঘোড়াঘাটে মোট সাতটি দল গঠন করা হয়েছে, যার সদস্য সংখ্যা ১৬৭। ওই গ্রামে একটি দলেই রয়েছেন এমন ২৩ নারী, যাঁরা স্বাবলম্বী হয়েছেন নিজ বাড়িতে নিজ উদ্যোগেই। তবে এই প্রকল্প শুরু হওয়ার পর শুধু সদস্যরাই নন, গ্রামের অন্য নারীরাও এমন উপার্জনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষিতে ২৩ নারীর এ সাফল্য নারীর ক্ষমতায়নের এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত। ফারজানা বেগমদের সাফল্যের গল্প প্রমাণ করে যথাযথ সুযোগ পেলে নারী কৃষকরাও সমাজে এগিয়ে যেতে পারে সমান তালে।

একশনএইড বাংলাদেশের উপব্যবস্থাপক অমিত রঞ্জন দে বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য পুরুষের পাশাপাশি সমাজে নারীর অবদানকেও তুলে ধরা। নারীদের স্বাবলম্বী করা এবং তাঁদের উৎপাদন তথা বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। আমরা চেয়েছি, নারী নেতৃত্ব তৈরি করতে। আমরা যেটা চেয়েছি, তাতে আমরা সফল বলতে পারি। এই এলাকার নারীদের দেখলেই তা বোঝা যায়।’