- সারাদেশ
- তদন্ত কমিটি যেখানে হাত দিচ্ছে, সেখানেই অনিয়ম
তদন্ত কমিটি যেখানে হাত দিচ্ছে, সেখানেই অনিয়ম
সীমা অক্সিজেন প্লান্ট দুর্ঘটনা

দেশের জাহাজ ভাঙা ও ইস্পাত খাতের পরিচিত নাম ছিলেন মোহাম্মদ শফি। চার দশক আগে সামান্য চায়ের দোকানদার থেকে নিজের মেধা ও শ্রম কাজে লাগিয়ে বিন্দু বিন্দু করে গড়ে তুলেছিলেন সীমা স্টিল অটো রি-রোলিং মিলস, সীমা অক্সিজেন প্লান্ট, সীমা স্টিল, এস ট্রেডিং করপোরেশন, মামুন স্টিল, ম্যাপস ট্রেডিংসহ প্রায় একডজন প্রতিষ্ঠান। সব মিলে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সীমা গ্রুপ দেশের শিল্প খাতে আলাদা স্থান করে নিয়েছিল। কিন্তু বছর তিনেক আগে মোহাম্মদ শফির মৃত্যুর পর তাঁর হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ আজ নিঃশেষের পথে। তাঁর তিন সন্তানের কেউ বাবার সুনাম তো ধরে রাখতে পারেননি, উল্টো ব্যাংকে জমেছে হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ। সে ঋণও নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছেন না তাঁরা। নিয়ম মেনে পরিচালনা করতে পারছেন না কোনো প্রতিষ্ঠান। ফলে সীমা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একে একে বন্ধ হচ্ছে, গাফিলতিতে ঘটছে দুর্ঘটনা। সর্বশেষ গত ৪ মার্চ বিকেলে সীতাকুণ্ডে সীমা অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছেন ৭ জন।
সীমা অক্সিজেন প্লান্টে দুর্ঘটনায় ভালোভাবেই ফেঁসে যাচ্ছেন মোহাম্মদ শফির তিন সন্তান মামুন উদ্দিন, পারভেজ উদ্দিন ও আশরাফ উদ্দিন। কারণ কারখানাটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তাঁরা। এরই মধ্যে প্লান্ট পরিচালনায় অনিয়ম ও গাফিলতির অভিযোগ এনে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ৭ জনের প্রাণহানির ঘটনায় প্লান্টের এমডি মামুন উদ্দিন, দুই পরিচালক পারভেজ উদ্দিন ও আশরাফ উদ্দিনসহ ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে গত মঙ্গলবার রাতে সীতাকুণ্ড থানায় মামলা করেন নিহত আবদুল কাদেরের স্ত্রী রোকেয়া বেগম। কারখানা কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও গাফিলতির কারণে এই মৃত্যু হয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করেছেন তিনি।
এদিকে অক্সিজেন প্লান্ট পরিচালনায় পদে পদে অনিয়ম পাচ্ছে তদন্ত কমিটি। দক্ষ জনবল না দিয়ে অনভিজ্ঞ ও অযোগ্য লোক দিয়ে স্পর্শকাতর এ স্থাপনা পরিচালনার বিষয়টি ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি নিশ্চিত হয়েছে। কমিটির প্রধান ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব হাসান বলেন, ‘সীমা গ্রুপের এক সময় খুব সুনাম ছিল। তদন্তের প্রয়োজনে যাদের সঙ্গে কথা বলছি, তারা সবাই এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার প্রয়াত মোহাম্মদ শফির সুনাম করেছেন। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া সম্পদ যথাযথভাবে পরিচালনা করতে পারছেন না সন্তানরা। যে অক্সিজেন প্লান্টে মানুষ হতাহত হয়েছে, সেখানে অসংখ্য অনিয়ম পাচ্ছি আমরা। তদন্ত রিপোর্টে বিস্তারিত তুলে ধরবো।’
সীতাকুণ্ডের ইউএনও শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘দুটি কোম্পানির মাধ্যমে সীমা গ্রুপ পাঁচটি প্লান্ট পরিচালনা করত। এখন তাদের পাঁচটি প্লান্টই বন্ধ হয়ে গেছে। এ গ্রুপের আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রুগ্ণ অবস্থায় আছে। এক সময় সীমা গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠান জমজমাট ছিল। তাদের লেনদেনও ছিল হাজার কোটি টাকার বেশি।
সীতাকুণ্ড থানার ওসি তোফায়েল আহমদ বলেন, অক্সিজেন প্লান্ট পরিচালনায় যে প্রযুক্তি ও জনবল দরকার, তা ওই প্রতিষ্ঠানে ছিল না। সীমা গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও চলছে জোড়াতালি দিয়ে। মালিকপক্ষকে আমরা যেসব কাগজপত্র দেখাতে বলেছি, কোনোটিই তারা সরবরাহ করতে পারছে না। অথচ একসময় অনেক সুনাম ছিল সীমা গ্রুপের।
মোহাম্মদ শফির নিকটাত্মীয় ও সমসাময়িক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুর্ঘটনা ঘটা সীমা অক্সিজেন প্লান্টে একসময় ত্রুটি পেয়েছিল কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। এরপর প্লান্টটিকে নোটিশও দেওয়া হয়েছিল বলে জানান অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মিনা মাসুদউজ্জামান। তারপরও প্লান্টের সেসব ত্রুটি সংশোধন করেনি শিল্পপতি শফির সন্তানরা। অদক্ষ লোক দিয়েই প্লান্ট চালাতেন তাঁরা।
এ বিষয়ে মোহাম্মদ শফির বড় ছেলে ও সীমা অক্সিজেন প্লান্টের এমডি মামুন উদ্দিন বলেন, ‘বাবার মৃত্যুর পর আমরা কিছুটা বেকায়দায় আছি। অক্সিজেন প্লান্টে ৭ জনের মৃত্যু আমাদের অবস্থা আরও খারাপ করে দিয়েছে। তবে আমরা সামলে ওঠার চেষ্টা করছি। বাবার সুনাম পুনরুদ্ধার করাই এখন আমাদের চ্যালেঞ্জ।’
মন্তব্য করুন