প্রথম দৃশ্য
দূরে গ্রামে আগুন ধরছে।
দেখা যাচ্ছে গ্রামে থেকে থেকে আগুন জ্বলে উঠছে।
গভীর রাত। ক্যামেরা ধীরে ধীরে দূর গ্রাউন্ড থেকে ধরে চলে আসবে খালের পাশে।
খালের দুই পাড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, রাজাকারের সাথে যুদ্ধ হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের।
দুই পাড়ে প্রচণ্ড লড়াই চলছে।
ক্যামেরা শব্দ-দৈর্ঘ্যের দূরত্ব থেকে দেখাতে দেখাতে ডানদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অংশের দিকে চলে আসবে।
দ্বিতীয় দৃশ্য
লড়াই চলছে, যুদ্ধ করছে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা
একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত বয়স্ক।
নাম রহমত, দলের সবাই তাকে রহমত চাচা বলে ডাকে।
তার রক্তক্ষরণ হচ্ছে, গামছা দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে বুকের একপাশ এবং তিনি কাতরাচ্ছেন।
একজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন–
তরুণ মুক্তিযোদ্ধা : চলেন চাচা, আপনারে নিয়ে আমরা আগে আগে নিরাপদ জায়গায় চইলা যাই, আপনের চিকিৎসা লাগবে।
রহমত চাচা : বাবা, আগে এই শুয়োরের বাচ্চাগো সামলাও। এই রাজাকার, পাকিস্তানিগো সামলাও। এই জানোয়ারগো সামলাও। আমার দিকে তোমাগো দেখতে হইবো না। যাও যাও যুদ্ধ করো, যুদ্ধ করো। দ্যাশ স্বাধীন করতে হইবো। তুমি আমারে নিয়া ভাইবো না, যাও যাও। যুদ্ধ করো।
তৃতীয় দৃশ্য
কমান্ডার এসে বলে–
কমান্ডার : রহমত চাচা, এখনই তোমারে যাইতে হইবো তোমার চিকিৎসা লাগব। তুমি আর কোনো কথা কইয়ো না। হাসু আর কাশেম, অরা দুইজন তোমরে নিয়া যাইবো আমাদের যে ক্যাম্প আছে, এই ক্যাম্পে। যাও, তুমি আর কথা কইয়ো না।
রহমত চাচা অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাসু আর কাশেমের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়ান, ওরা ধরে।
এদিকে চারদিকে গুলির শব্দ হচ্ছে, অন্ধকার রাত।
গুলি খুলছে গুলি ভরছে, আবার এসএমজির শব্দ
স্টেনগানের শব্দ, দু-চারটা রাইফেলের শব্দ
উভয় পক্ষের তুমুল লড়াই হচ্ছে।
চতুর্থ দৃশ্য
কমান্ডার: যুদ্ধের অবস্থা যা, তাতে মনে হইতাছে অগো সাথে এইভাবে না, দুই দিক থাইকা আক্রমণ করতে হইবো।
এ সময় দ্রুতগতিতে এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা এসে কমান্ডারকে জানায়-
তরুণ : যে দলটির যুক্ত হওয়ার কথা ছিল পথে তাদের রাজাকারদের সাথে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। তাই আসতে পারে নাই।
সংবাদটি শুনে কমান্ডার বলে-
কমান্ডার : এই আমাগো এইখানে আটজনের মধ্যে থেকে আমরা চারজনের একটি দল খালপাড় হইয়া পেছন দিক থাইকা অগোর উপর আক্রমণ করমু। আর এইদিক দিয়ে তোমরা চারজন গুলি ছুড়তে থাকবা। আমরা চারজন খাল পার হইয়া পেছন দিক থাইকা আক্রমণ করমু। তোমরা এদিক থাইকা কাভারিং ফায়ার দিতে থাকবা। অরা ভাববো, আমরা এইদিকেই আছি। এইতো কথা। চলো চলো, তাড়াতাড়ি যাই।
পঞ্চম দৃশ্য
যেতে যেতে রহমত চিৎকার করে ওঠে–
রহমত চাচা : তাড়াতাড়ি যাও, কমান্ডার, দেরি হয়া যাইতাছে। চাচা, তোমরা যাও, আমরা এইদিক দিয়া যাইতাছি।
হঠাৎ চাচা ঘাড় ফেরায়। কাশেম আর হাসুর কাঁধে ভর দিয়ে চাচা বলে–
রহমত চাচা: হ যাও, তোমরা যাও। আমাগো নিয়া ভাইবো না। এ রকম লক্ষ লক্ষ জীবন দিয়া দ্যাশরে স্বাধীন করতে হইবো। এইটাই স্বাধীনতার ইতিহাস। কষ্ট নাই, কষ্ট নাই। কী হইছে, জীবন তো একটাই । যাও বাবা, যাও। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু কইতে কইতে যাও।
এই কথা বলার পরে ঘাড় ফেরায়। হাসু আর কাশেম তাকে নিয়ে যেতে থাকে। অন্ধকার রাত, একটু একটু ভেজা মাটি। ক্ষেতের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। রহমত চাচা একটু পরপর কাতরাতে থাকে।
রহমত চাচা : এই যে বাবু পোলাডা-শোন হাসু, বাবু কিন্তু খুব ছোট। অর কিন্তু ১৫ বছর হয় নাই, অরে দেইখা রাখিস। আমি আরে নিয়া আসছিলাম।
কাশেম : চাচা, এ নিয়া তোমার ভাবতে হইবো না। ও সাহসী পোলা। দেখো না, কয়টা জানোয়ার মারে।
বলতে বলতে যেতে থাকে।
ষষ্ঠ দৃশ্য
ক্যামেরায় চলে আসে চারজন মুক্তিযোদ্ধা। ক্রলিং করতে করতে খালের কাছে এসে তারা খাল পার হয়। অন্ধকার রাত, নিঝুম রাত, চারিদিকে প্রচণ্ড গুলির শব্দ হচ্ছে এদিকে তারা এলএমজি মাথায় নিয়ে খাল পার হয়। খাল পার হয়ে উঠতেই যে সড়ক তার কোনায় তিনজন রাজাকার বসে আছে। এদিক দিয়ে কেউ আক্রমণ করে কিনা, সেটা বুঝতে পেরে কমান্ডার বলে–
কমান্ডার : আচ্ছা শোনো, চুপ! কোনো কথা বুইলো না। ঐ যে শালারা সামনে। দেখতে পাইতাছ? কোনো কথা নাই, ঐ পেছন দিকে ঢিল মারবা। ঢিল মারলে ওরা ঘুরবে, আমরা পেছন দিক থেকে আক্রমণ করব। গুলি করা যাইবো না, ঢিল মারতে হইবো কাছাকাছি গিয়া। গুলি করলে পাকিস্তানিরা বুইঝা ফালাইবো, আমরা পিছন নিয়া আসতাছি। তাই গুলি না, বেয়নেট দিয়া মারতে হইবো। ঐ ঢালু দিয়া ওঠো, ঠিক নিচের থাইকা ঢিলটা মারবা, আন্ধারে ঢিল দেখা যাইবো না। আওয়াজ পাইলেই অরা ঘুরবো। তখন আমরা যারা বেয়নেট চার্জ করবো। এইভাবেই খতম করুম এই দালালগো। চুপ। রেডি।
সপ্তম দৃশ্য
সাথে সাথে সবাই চুপ থাকে।
আস্তে আস্তে পাড়ের কাছে গিয়ে একটা ঢিল মারে বাবু। ঢিলটা ছোড়ামাত্রই তিনটি রাজাকার ঘাড় ফেরায়–
রাজাকার : কে রে, কই থাইকা চাক্কা আইলো? অই দেখ তো, দেখ তো—
রাজাকার-২ : কোন হালায় চাক্কা মারে।
বলতেই ঘাড় ঘোরায় আর পেছনদিক থেকে আক্রমণ করে কমান্ডার, বাবুসহ আরও দু’জন। বেয়নেট চার্জের আক্রমণে তারা নিহত হয়।
অষ্টম দৃশ্য
রহমত চাচা : আর পারতাছি না। এখন রাখ, আমারে রাখ। আরাম কইরা মরতে দে। আমি আর পারুম না, তরা চইলা যা। যুদ্ধে যা। দেশ স্বাধীন করতে হইবো। ভয় করিস না, আমি আছি। আমি তোগো সবাইর মধ্যে আছি। আমি তো ছোট না, আমি তগো সবাইর বড়। আমি তগো রহমত চাচা, আমার গতর ধইরা কসম কর, যুদ্ধ কইরা দেশ স্বাধীন করবি। যুদ্ধ ছাড়া মুক্তি নাই। দ্যাখ বঙ্গবন্ধু আমাগো সেই কথাই কইছে। লড়াই কর, যা, যা কিছু আছে নিয়া লড়াই কর। যা তোরা, আমি আর পারি না। আমারে একটু বিশ্রাম দে, যা তোরা। যারে বাজান।
বলেই ঝাড়া দিয়ে হাসু আর কাশেমের কাঁধ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। হাসু আর কাশেম বলে–
হাসু/কাশেম: চাচা, চাচা ...
রহমত চাচা : তরা যা, আমারে ধরবি না। আল্লাহর কসম লাগে আমার গায়ে হাত দিবি না। ঐদিকে দেখ ওরা কী করে। আমি আমার মতো আছি, নিরাপদ জায়গায় চইলা আইছি। আমারে নিয়া তোগো ভাবতে হইবো না। তোরা যা
নবম দৃশ্য
রহমত চিৎকার করতে থাকে। হাসু কাশেমকে বলে–
হাসু : কাশেম শোন, চাচায় কিন্তু অস্থির হয়া গেছে। এখন চাচার কাছে বইসা থাকুম, না আমরা যুদ্ধে যামু?
কাশেম : চল হাসু, চাচায় কিন্তু নিরাপদ জায়গায়ই আছে। এইখানে অরা চাচারে পাইবো না। একটু পরেই তো সকাল হয়া যাইবো, লোকজন আইসা চাচারে পাইয়া চিকিৎসা দিবো। চল আমরা যুদ্ধে যাই, দেখি কমান্ডার কোনদিকে গেছে—
রহমত চাচা: না, আমারে ধরিস না। তগো আল্লাহর কসম, আমারে ধরতে পারবি না। দূরে থাক, যা যুদ্ধে যা। আমি আমার মতো থাকি। এইখানে আমারে পাইবো না। আমি আস্তে আস্তে পৌঁছায়া যামু। তরা আর দেরি করিস না, যা।
এ কথা বলতেই কাশেম আর হাসু দুইজন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে–
হাসু/কাশেম : চাচা, আর বুঝি দেখা হইবো না। তয় তুমি বাঁইচা থাকো। স্বাধীন দেইখা যাও। এই আশা বুকে নিয়া রইলাম।
দশম দৃশ্য
তারা অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। রহমত মাটিতে বসে পড়ে। ফ্ল্যাশব্যাক
রহমতের মনে পড়ে স্ত্রী আর মেঘের কথা।
তাদের সুসময়, হানাদার বাহিনীর আক্রমণ
রাজাকাররা তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
গ্রামের পর গ্রাম জ্বলছে। লাশ ভেসে যাচ্ছে খাল দিয়ে।
ফ্ল্যাশব্যাক কাট-টু
চিন্তা করে আর মনে মনে বিড়বিড় করে।
রহমত চাচা: আস্তে আস্তে একটু সামনে যাই। সামনে গেলেই তো মানুষ পাওয়া যাইবো। সামনে গেলে তো বাঁইচাও যাইতে পারি। স্বাধীন দ্যাখতে হইবো, স্বাধীন কী জিনিস? জয় বাংলা। আমি দেখতে চাই, জয় বাংলা আমি দেখতে চাই আমার বাঁচতে হইবো।
মাটিতে পড়ে মাটি খামচে আস্তে আস্তে মাটি হাতড়ে হাতড়ে সামনে যেতে চায়। এক পর্যায়ে সদা উদিত সূর্যের দিকে হাতটা বাড়িয়ে বলে–
রহমত চাচা : দ্যাশ স্বাধীন হইবোই। সারাজীবন মানুষ স্বাধীন সুখ পাউক। আমিও সুখ পাইলাম। কিসের সুখ? আমি রহমত কিসের সুখ পাইলাম? আমি রহমত স্বাধীন সুখ পাইলাম। কীভাবে পাইলিরে রহমত? দেশের জইন্য জীবন দিয়া-ই আমি সেই সুখ পাইলাম। সেই সুখ দুই চোখে দেখি। সারাজীবন আমি দেখুম সেই সুখ।
আবারও মাটি হাতড়াতে থাকে।
হাতটা আবার পড়ে যায়। আর নেপথ্যে বেজে ওঠে–
ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা
তোমাতে বিশ্বময়ী, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা
ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা
মাটিতে পড়ে মাটি খামচে খামচে রহমত চাচা যেতে থাকে।
দূরে সূর্যটা অন্ধকার চিরে মুখ দেখায়। ভোরের স্নিগ্ধ সূর্যের আলোর ভেতর দিয়ে রহমতের চোখে ভাসে বঙ্গবন্ধুর মুখ, বাংলাদেশের পতাকা যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধারা। রহমত প্রাণপণে চিৎকার করে ওঠে– জয় বাংলা!
ভাস্কর রাসা
প্রকাশ: ১০ মার্চ ২৩ । ০০:০০ । প্রিন্ট সংস্করণ
মন্তব্য করুন