- সারাদেশ
- নিছক অপরাধমূলক নহে
নিছক অপরাধমূলক নহে

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চর রমণীমোহন ইউনিয়নের এক ইটভাটায় একজন শ্রমিককে শিকলে বাঁধিয়া নির্যাতন এবং তাঁহার স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের যে অভিযোগ উঠিয়াছে, উহা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। শুক্রবার সমকালের এক প্রতিবেদনে ধর্ষিত নারীকে উদ্ধৃত করিয়া যেমনটা বলা হইয়াছে, উক্ত ইটভাটায় কর্মরত তাঁহাদের এক আত্মীয় মালিকের টাকা আত্মসাৎ করিয়া চম্পট– এমন অভিযোগ তুলিয়া গত ৭ মার্চ ঐ নারীর স্বামীকে, যিনি নিজেও তথায় শ্রমিক হিসাবে কর্মরত; ইটভাটার সর্দাররা শিকল দিয়া বাঁধিয়া নির্যাতনের পাশাপাশি আটকাইয়া রাখে।
সর্দারদের বক্তব্য– মালিকের টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত আটককৃত শ্রমিককে মুক্ত করা হইবে না। উপরন্তু স্বামীর সন্ধানে ইটভাটায় গেলে সর্দাররা উক্ত নারীকে কুপ্রস্তাব দিয়া রাজি না হইলে উহাদের সহযোগীসহ ধর্ষণ করে। প্রথমত, মালিকের পাওনা টাকা পরিশোধ না করিয়া পালাইবার অভিযোগটি সত্য হইলেও তজ্জন্য উক্ত নারী কিংবা তাঁহার স্বামীকে দায়ী করা যায় না। দ্বিতীয়ত, ভুক্তভোগীদের কাহারও ঐ কথিত টাকা আত্মসাতের সহিত সম্পৃক্ততা থাকিলেও সর্দারদিগের এহেন নির্যাতন চালাইবার অধিকার জন্মায় না।
আমাদের উদ্বেগের আরেক কারণ, স্থানীয় পুলিশ ভুক্তভোগী নারীর আহ্বানে সাড়া দিয়া তাঁহার স্বামীকে উদ্ধার করিলেও অন্তত প্রতিবেদনমতে, অপরাধীদের আইনের আওতায় লয় নাই। বরং জেলা পুলিশ সুপারের বক্তব্য শুনিলে মনে হইতে পারে, বিষয়টা মূলত ইটভাটার মালিক-শ্রমিকের মধ্যকার অর্থ লেনদেনের সহিত জড়িত। অর্থাৎ গুরুতর কিছু ইহাতে নাও থাকিতে পারে।
ইহা অনস্বীকার্য, আপাতদৃষ্টে ঘটনাকে আর দশটা ফৌজদারি অপরাধের সহিত তুলনীয়। স্বামীকে বাঁধিয়া রাখিয়া স্ত্রীর উপর পাশবিক নির্যাতন চালাইবার ঘটনাও ইতোপূর্বে দেশের বিভিন্নস্থানে কম ঘটে নাই। তবে ইহাও স্বীকার করিতে হইবে, প্রায়ই এহেন বর্বরোচিত অপরাধের শিকার হইয়া থাকে ব্যতিক্রমহীনভাবে সমাজের দরিদ্র-অসহায় মানুষ; যথায় অপরাধীরা হয় ধনী ও ক্ষমতাবান অথবা তাহাদের প্রতিনিধি। আলেচ্য ঘটনায় আরেক বিষয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন বলিয়া আমরা মনে করি; উহা হইল– ঘটনাস্থল ইটভাটায় শ্রমিকের জীবন অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর দশটা খাতের শ্রমিকের অনুরূপ নহে।
ইতোপূর্বে এই বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বহুবার লিখালিখি হইয়াছে যে, ইটভাটার মালিকেরা শ্রমিকদের চরম দারিদ্র্যের সুযোগ লইয়া এক প্রকার দাদন প্রথার মাধ্যমে তাহাদের নিয়োজিত করিয়া থাকে, যে প্রথার অধীনে শ্রমিককে কাজ করিতে হয় মালিকের শর্তে এবং মালিকের নিকট হইতে অগ্রিম হিসাবে গ্রহণ করা টাকা পরিশোধ না করিয়া কোনো শ্রমিক কাজ ছাড়িতে বা অন্যত্র চাকুরি লইতে পারে না। মোট কথা, দেশের বহু ইটভাটায় অদ্যাবধি সেই আদিম যুগের শ্রমদাসত্ব বিভিন্ন রূপে টিকিয়া রহিয়াছে। লক্ষ্মীপুরের আলোচ্য ইটভাটায়ও যে এহেন বর্বর প্রথা নাই– কে বলিতে পারে! মনে রাখিতে হইবে, বাংলাদেশে বেশ কার্যকর শ্রম আইন থাকিলেও ইটভাটার ন্যায় ৯০ শতাংশের অধিক অনানুষ্ঠানিক খাতের শিল্প অদ্যাবধি উক্ত আইনের আওতার বাহিরে।
এই কারণেই আমরা মনে করি, স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের আলোচ্য ঘটনাটিকে গুরুত্বের সহিত গ্রহণ করা উচিত। প্রথমত, অবিলম্বে উক্ত অপরাধ সংঘটনের দায়ে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করিতে হইবে; তৎসহিত একটা স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে উক্ত অপরাধের প্রকৃতি এবং নেপথ্যের ঘটনাবলি তুলিয়া আনা দরকার, যাহার ভিত্তিতে দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করিতে হইবে।
যদি তদন্তে উক্ত অপরাধের পশ্চাতে শ্রমদাসত্বের কোনো বিষয় যুক্ত থাকে তাহা হইলে ইটভাটার মালিককেও আইনের আওতায় আনিয়া এহেন বর্বর প্রথার মূলোৎপাটনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে হইবে। একটা সভ্য সমাজে যথায় সকল নাগরিকের একটা মানসম্মত জীবনযাপন নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তথায় শ্রমজীবী মানুষদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশকে মালিকের খেয়ালখুশির দাসরূপে ফেলিয়া রাখা যায় না।
মন্তব্য করুন