সর্বোচ্চ আদালতে আটকে আছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের ৪০টি মামলা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্তরা আপিল বিভাগে আবেদনের পর এরই মধ্যে পৌনে চার বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু এসব মামলার শুনানির বিষয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। চূড়ান্ত শুনানি বিলম্বিত হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের উদ্যোগের অভাবকেই দায়ী করছেন আইনজ্ঞরা। তাঁরা মনে করেন, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আপিল বিভাগে বিশেষ বেঞ্চ গঠন প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ চললেও গত পৌনে চার বছরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডাদেশপ্রাপ্তদের কোনো আপিল শুনানি হয়নি। এরই মধ্যে মহামারি করোনার কারণে সর্বোচ্চ আদালতে এসব আপিল মামলার স্বাভাবিক কার্যক্রম প্রায় দুই বছর বন্ধ ছিল। পরে আরও দুই বছর পার হয়। আইনজীবীরা মনে করেন, এসব আপিল শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের সদিচ্ছার অভাব আছে। আর দীর্ঘদিন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আপিল শুনানি না হওয়ায় হতাশ বিচারপ্রার্থী পরিবারগুলো।

আপিল বিভাগে অন্য সব মামলার সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের মামলাগুলোও যোগ হয়ে দীর্ঘসূত্রতায় পড়ছে। অনেক দেশে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিশেষ মামলার আপিল নিষ্পত্তি করতে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করা হয়। এসব মামলার আপিলের ক্ষেত্রেও বিশেষ বেঞ্চ করলে দ্রুত আপিল নিষ্পত্তির মাধ্যমে রায় কার্যকর করা যাবে। যুদ্ধাপরাধের মামলাগুলো বিশেষ প্রকৃতির ও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলেই পৃথক ট্রাইব্যুনাল করে বিচার করা হচ্ছে। ফলে যথাসম্ভব দ্রুত সময়ে এগুলোর তদন্ত ও বিচার সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু আপিল বিভাগে গিয়ে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই চূড়ান্ত শুনানি দীর্ঘসূত্রতায় পড়ছে। এ প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সমকালকে বলেন, দীর্ঘদিন আপিল শুনানির অপেক্ষায় থাকাটা সঠিক নয়। রাষ্ট্রপক্ষের পাশাপাশি আদালতকেও উদ্যোগ নিতে হবে।

সাধারণত অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকে আপিল মামলা দ্রুত শুনানির দিন ধার্য করতে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার আদালতে আবেদন দাখিল করা হয়। ওই আদালত তারিখ নির্ধারণ করে শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। সেই অনুযায়ী শুনানি হয়। জানা গেছে, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকে যুদ্ধাপরাধীদের মামলার আপিল শুনানির জন্য এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেই। অবশ্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (সংশোধনী) আইনের ২১(৪) ধারা অনুযায়ী আপিল দাখিলের ৬০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করার কথা রয়েছে। আইনজ্ঞরা বলছেন, এ বিধান আপিল বিভাগের জন্য বাধ্যতামূলক নয়, বরং নির্দেশনামূলক। আপিল বিভাগ তাঁদের অন্তর্নিহিত ক্ষমতায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে মামলা শুনানি করবেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধের মামলার শুনানি হবে। যদিও দীর্ঘদিন ধরে আপিল বিভাগে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা ঝুলে আছে। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বেঞ্চ গঠন ও দ্রুত আপিল শুনানির বিষয়ে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

জানা গেছে, যুদ্ধাপরাধ বিচারের সর্বশেষ আপিল শুনানি হয় ২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সেদিন মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী হবিগঞ্জের সৈয়দ মুহাম্মদ কায়সারের আপিলের শুনানি হয়। এর পর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ ২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি রায়ে কায়সারের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে কায়সার একই বছরের ৩০ অক্টোবর আপিল বিভাগে আবেদন করেন। রিভিউ আবেদনের শুনানি এখনও শুরু হয়নি। এ ছাড়া জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখায় ২০২০ সালে ১৯ জুলাই তিনি রিভিউ আবেদন করেন। সেটিও শুনানির অপেক্ষায় আছে।

এ প্রসঙ্গে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সাজার বিরুদ্ধে আপিল দীর্ঘদিন শুনানি না হওয়াটা খুবই দুঃখজনক। আপিল বিভাগে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত ১০ বছরে সৈয়দ মুহাম্মদ কায়সারের আবেদনসহ এ পর্যন্ত মাত্র ৯টি আপিল নিষ্পত্তি করেছেন আপিল বিভাগ।

আপিল বিভাগে পর্যায়ক্রমে শুনানির অপেক্ষায় আছে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা মোবারক হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আফসার হোসেন ও মাহিদুর রহমান চুটু, পটুয়াখালীর ফোরকান মল্লিক, বাগেরহাটের সিরাজুল হক ও খান আকরাম হোসেন, নেত্রকোনার আতাউর রহমান ননী ও ওবায়দুল হক খান তাহের, কিশোরগঞ্জের শামসুদ্দিন আহমেদ, হবিগঞ্জের মহিবুর রহমান বড় মিয়া, মুজিবুর রহমান আঙ্গুর মিয়া ও আবদুর রাজ্জাক, জামালপুরের দুই রাজাকার এবং যশোরের সাবেক এমপি সাবেক জামায়াত নেতা সাখাওয়াত হোসেন, ইউসুফ আলী, বিল্লাল হোসেন, আব্দুল লতিফ, আমির আহমেদ, জয়নুল আবেদীন, আব্দুল কুদ্দুস, হামিদুর রহমান আজাদ, গণি হাওলাদার, রিয়াজউদ্দিন ফকির, ইসহাক শিকদার, রনজু মিয়া, খলিলুর রহমান, আব্দুল আজিজ হাবলু, আব্দুল মান্নান প্রমুখ।