জঙ্গিবাদে জড়ানোর অভিযোগে ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার হয়েছিল রাজশাহীর বেলপুকুরের ক্ষুদ্র জামিরা এলাকার আবু তালহা। পরে জামিনে বেরও হয়ে আসে। তালহা এখন এলাকায় মোটর পার্টসের দোকানকর্মী। রাজশাহীতে তালহার মতো ১১১ জঙ্গি রয়েছে জামিনে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে তাদের সবার বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও আঁধার পেরিয়ে আলো ছুঁতে চায় তারা। এ প্রেক্ষাপটে রাজশাহী মহানগর পুলিশ নেয় অভিনব প্রয়াস। জামিনে বের হওয়া জঙ্গিরা প্রতি শুক্রবার স্থানীয় থানায় গিয়ে ডি- র‍্যাডিক্যালাইজেশন কর্মসূচির আওতায় উদ্দীপনামূলক বক্তব্য শুনছে। তারা রয়েছে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফেরার লড়াইয়ে। সবাই কোনো না কোনো কাজ করে সংসারের হাল ধরছে। জঙ্গিবাদ মামলার এতসংখ্যক আসামিকে এ ধরনের কর্মসূচির আওতায় আনার উদ্যোগ নজিরবিহীন। এখন বেলপুকুর থানায় পরীক্ষামূলক চলছে এ কার্যক্রম। এপ্রিল থেকে আরও চার থানায় এ কর্মসূচি শুরু হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজশাহী মহানগর এলাকায় তালিকাভুক্ত জঙ্গির সংখ্যা ১১১। এর মধ্যে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) ৮৬ জন, হিযবুত তাহ্‌রীরের ১৫ জন, আনসার আল ইসলামের ৯ জন ও শাহাদাত আল হিকমার একজন রয়েছে। এর বাইরে অন্য এলাকা থেকে ওই অঞ্চলে গিয়ে উগ্রপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছে এমন জঙ্গির সংখ্যা ৭৩।

যেসব জঙ্গিকে এই কর্মসূচিতে নেওয়া হচ্ছে তাদের সবাই রয়েছে জামিনে। তালিকাভুক্ত জঙ্গিদের মধ্যে মতিহার থানার ৪৯ জন, বোয়ালিয়ার ৯ জন, রাজপাড়ার দু’জন, বেলপুকুরের ৩৮ জন এবং পবার রয়েছে ১২ জন। বেলপুকুর থানায় প্রতি শুক্রবার ৩৮ জন একযোগে হাজিরা দেয়। থানার একটি রেজিস্টারে সইও করে তারা। রাজশাহীর বাইরে গেলে কেন, কী কারণে কার সঙ্গে দেখা করতে যাবে, তা সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে জানিয়ে যেতে হয়।

কেন এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে– এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, জামিনে বেরিয়ে অনেক জঙ্গি আবার পুরোনো পথে হাঁটে। কেউ কেউ পরিবারকে না জানিয়েই নিরুদ্দেশ হচ্ছে। কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে ঘরে ছেড়ে জঙ্গিদের গোপন আস্তানায় গিয়ে প্রশিক্ষণও নেয়। অনেক জঙ্গি জামিনে বেরিয়ে সরাসরি অপারেশনে যাচ্ছে। এই পথ থেকে জঙ্গিদের ফেরাতে ডি-রেডিকালাইজেশন কর্মসূচি জরুরি। পরিবার ও সমাজের মূল স্রোত ধারায় তারা যাতে স্বাভাবিকভাবে মিশতে পারে, তার নিশ্চয়তা দেওয়া দরকার।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার আনিসুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘এটি আমাদের প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম। থানায় তাদের নিয়মিত হাজিরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জামিনে মুক্ত জঙ্গি মামলার আসামিরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার অঙ্গীকার করেছে। আমরাও চাই জঙ্গি মামলার আসামিরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক। প্রাথমিকভাবে বেলপুকুর থানাকে এই কার্যক্রমের মডেল হিসেবে নেওয়া হয়েছে। সেখানে জঙ্গিরা থানায় এসে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছে।’

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, ‘জঙ্গিরা আদর্শভিত্তিক মতবাদ নিয়ে কাজ করে। তাদের মস্তিষ্ক থেকে ভুল মতাদর্শকে বিতাড়িত করতে বিশ্বের অনেক জায়গায় ডি-রেডিকালাইজেশন কর্মসূচি নিতে দেখি। রাজশাহীতে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা ওই অঞ্চলের জঙ্গিবাদ মূলোৎপাটনের শুভসূচনা বলা যেতে পারে।’

রাজশাহীতে যেসব জঙ্গি সদস্যকে সুপথে ফেরার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, ২০০৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে তারা বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল। বেলপুকুর থানায় যে ৩৭ জন প্রতি শুক্রবার থানায় হাজিরা দিচ্ছে, তাদের মধ্যে রয়েছে আনিসুর রহমান, আফরোজা বেগম, রুহুল আমিন, মামুন অর রশিদ, আবু তালহা, আবু দাউদ, সাইদুর রহমান, মো. সাহিন, বাবর মুন্সী, নজরুল ইসলাম, আবদুর রহিম, মিজানুর রহমান, মো. মুকুল, শাহিদুল ইসলাম, মো. আনিছুর, মো. হাইদুল্লাহ, মো. আফান, মো. ফরহাদ, উজ্জ্বল হোসেন, মো. বুলবুল, মোশাররফ হোসেন, জাহিদুল ইসলাম, মো. সাদ্দাক, মো. তারিক, সাবর আলী, আমির আলী, রাজন আলী, মিজানুর রহমান, মনসুর রহমান, মেরাজুল ইসলাম, ইব্রাহিম সরকার, মাসুদ রানা, আরিফুল ইসলাম, লোকমান আলী, আতিকুর রহমান, মিজানুর রহমান ও মো. মামুন। এক জঙ্গি এখন কারাগারে রয়েছে।

জামিনে থাকা ১০ জনের সঙ্গে সমকালের কথা হয়। বেলপুকুরের সিদ্দিক আলীর ছেলে আবু দাউদ বলেন, ‘ঝামেলায় পড়েছিলাম। এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই। এখন ধান মিলের শ্রমিক হিসেবে কাজ করছি। মামলা চলছে। মাসে মাসে হাজিরা দিচ্ছি। শুক্রবার থানায় হাজিরার সময় একত্রিত হচ্ছি, এটা ভালো লাগছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রতিবেশীরা সন্দেহের চোখে এখন কম দেখে।’সাইদুর রহমান নামে আরেকজন বলেন, ‘জীবনের মূল্যবান অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। পরিবারের কাছে অনেক দায়। পেছনের দিন ভুলে সামনে এগোতে চাই।’

রাজশাহীর বেলপুকুর থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান বলেন, জঙ্গিদের মধ্যে সুপথে যারা ফিরতে চায়, তাদের তথ্য রাখার জন্য একটি ডাটাবেজ করা হয়েছে। পুরোনো পথে যাতে তারা না ফেরে এটাই আমাদের লক্ষ্য। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০৩ সালের মাঝামাঝি শায়খ আবদুর রহমানের পরামর্শে জেএমবির শূরা কমিটির প্রধান সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইয়ের নেতৃত্বে জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ বা জেএমজেবি গঠিত হয়। ২০০৪ সালে সংগঠনটি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। রাজশাহীর বাগমারা ও নওগাঁর আত্রাই-রানীনগর ছিল তাদের বিচরণক্ষেত্র। ২০০৪ সালের ২০ মে নওগাঁর রানীনগরের ইদ্রিস আলী ওরফে খেজুর আলী ও আব্দুল কাইয়ুম বাদশাকে হত্যা করে বাংলাভাই ও তার সহযোগীরা। এর পর বাদশার লাশ উল্টো করে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয় এবং খেজুর আলীকে টুকরো টুকরো করে লাশ পুঁতে ফেলা হয়। গাছে লাশ ঝুলিয়ে রাখার সেই ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে দেশজুড়ে পরিচিত হয়ে ওঠে ‘বাংলাভাই’। ২০০৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সরকার জেএমবি ও জেএমজেবির কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে ওই বছর ১৭ অগাস্ট ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা ফাটিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দেয় সংগঠনটি। ২০০৬ সালের ৬ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে বাংলাভাইকে র‍্যাব সদস্যরা গ্রেপ্তার করেন। এর চার দিন আগে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শায়খ আবদুর রহমানকে। ঝালকাঠির সিনিয়র সহকারী জজ সোহেল আহম্মেদ ও জগন্নাথ পাঁড়ের গাড়িতে বোমা হামলা চালিয়ে তাদের হত্যার দায়ে ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ শায়খ আবদুর রহমান, বাংলাভাইসহ ছয় শীর্ষ জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর করা হয়।