প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্য উভয়েরই জলজীবী ও জলের বাসিন্দাদের নিয়ে আগ্রহ প্রকাশের দরুন সৃষ্টি হয়েছে কালোত্তীর্ণ শিল্প। আমেরিকান বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ১৯৫৪ সালে তাঁর লিখিত উপন্যাস ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’-এর জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। সেখানে এক বৃদ্ধ মাঝি বিশালাকার এক মার্লিন মাছ বড়শিতে গেঁথেও পাড়ে তুলতে পারেন না অক্ষত অবস্থায় । এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে পাশ্চাত্য দর্শনের নিগূঢ় সত্য।

পাশ্চাত্য সর্বদা জয়-পরাজয়কে স্থূল অর্থে জয়-পরাজয় হিসেবেই দেখেছে। তাই বহুল আরাধ্য জয়ের মধ্য দিয়ে আগ্রাসী মনোভাবই ফুটে উঠেছে। কিন্তু প্রাচ্যদর্শন ঠিক এমন নয়, প্রাচ্য অনুভূতির সূক্ষ্মতায় পৌঁছে জয় ও পরাজয়কে ভিন্ন নয় বরং একই সুতোয় গাঁথতে চেয়েছে। সেখানে লড়াইটাই মুখ্য, জয়-পরাজয় একাঙ্গে লীন হয়ে যায় লড়াইয়ের সাহসিকতায়। প্রাচ্য দর্শনের এই অনুভূতির সূক্ষ্মতাকে আগলে রেখে প্রাচ্যের জল ও জলজীবীদের নিয়ে সেলিম আল দীন লিখেছেন তাঁর অপূর্ব নাট্য আখ্যান ‘স্বর্ণবোয়াল’।

সেলিম আল দীনের মৃত্যুর কিছুকাল আগে ২০০৭ সালে ফেব্রুয়ারির বইমেলায় ‘স্বর্ণবোয়াল’ নাটকটি প্রকাশিত হয়। তিনি নাটককে শুধু নাটক নয়, জননিরপেক্ষ সর্বব্যাপী শিল্প আঙ্গিক হিসেবে নির্মাণ করতে চেয়েছেন। এ নাটকটি তাঁর সেই দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পধারার অন্যতম নিদর্শন। প্রাচ্যের প্রবল হারজিতহীন শিকারদর্শন নিয়ে গঠিত এবং বর্ণাত্মক ধারায় রচিত ‘স্বর্ণবোয়াল’ নাটকটিতে আমরা এক অর্বাচীন জেলেপল্লির গল্প দেখতে পাই। বিলপাড়ের গাঁও গগনধুলার বাসিন্দা জলজীবী নিকারিদের কাছে স্বর্ণবোয়াল বিপুল আরাধ্য মাছ হিসেবে ঘোষিত।

সেই কবে এ পাড়ার অভিজ্ঞ শিকারি খলিশা মাঝির পিতা জনম মাঝি স্বর্ণবোয়াল শিকারে গিয়ে নৌকাসমেত নিরুদ্দেশ হয়েছিল। তবে তাতে সোনালি বর্ণ বোয়ালের স্বপ্নভূত খলিশা মাঝির মাথা থেকে একটুও দূরে সরেনি। এমনকি বহুকাল পরে এসে খলিশা মাঝির পুত্র তিরমনের মাঝেও সেই স্বপ্নভূত সমানভাবে বিরাজমান। স্বর্ণবোয়ালের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষাই তিরমনকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে প্রতি মুহূর্তে।

মায়ের কাছে শোনা বাবার মাছ শিকারের বীরত্বের গল্প এবং বাবার মুখে দাদা জনম মাঝির স্বর্ণবোয়াল শিকারের ভয়ংকর অভিযাত্রা তিরমনকে বারবার আকৃষ্ট করেছে জলের অতল গভীর থেকে সেই রূপসী সোনালি মাছের স্বরূপ উদঘাটন করতে। পাশাপাশি একেস্বরা সাঁঝমালার প্রতি বিপুল আকর্ষণ তাকে অনুপ্রেরণার সাগরে ভাসায়। বাক্যহীন সাঁঝমালার হাসি এ কথাই নির্দ্বিধায় বলে দেয় ‘তুমি স্বর্ণবোয়াল শিকার করবে তিরমন’। সেলিম আল দীনের বেশিরভাগ নাটকই ঢাকা থিয়েটার মঞ্চে আনলেও এই নাটকটি এখন পর্যন্ত ঢাকা থিয়েটারের ব্যানারে মঞ্চে আসেনি। তবে সেলিম আল দীনের মৃত্যুর কিছুকাল পর ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো অধ্যাপক আফসার আহমদের নির্দেশনায় মঞ্চে আসে ‘স্বর্ণবোয়াল’।

এরপর ২০১৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে রেজা আরিফের নির্দেশনায় পরীক্ষা প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। অতিসম্প্রতি নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে অধ্যাপক ইউসুফ হাসান অর্কের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয়েছে নাটকটি। নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ৪৬তম আবর্তনের চতুর্থ পর্ব স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষা প্রযোজনা হিসেবে গত ৪ ও ৫ জানুয়ারি থিয়েটার ল্যাব-৩, জহির রায়হান মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। পরে ১৪ জানুয়ারি নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের ১৬তম প্রয়াণ দিবস স্মরণে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত তিন দিনব্যাপী নাট্যোৎসবের প্রথম দিন অর্থাৎ ১৪ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চে মঞ্চস্থ হয়েছে নাটকটি। নাটকটির চতুর্থ মঞ্চায়ন সম্পন্ন হয়েছে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে।

প্রযোজনাটির শুরুতেই তিরমনকে আমরা বেউলা বিলে ছিপ ফেলা অবস্থায় দেখি। তখন সে ভ্রমের মতো দেখতে পায় পুরাকালের কোনো কোনো মৎস্য শিকারি ওত পেতে আছে চারপাশে। সেসব অবয়বহীন ছায়াশরীর মৎস্য শিকারি যেন তিরমনের মনের বাসনাকে আরও বেশি উদ্বেলিত করে তোলে। নাটকের বাঁকে বিভঙ্গে বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে অতল জলের গভীরে সোনালি রঙা বোয়ালটির শক্তিশালী অবস্থানের বিপরীতে তিরমনের প্রবল মনঃশক্তির লড়াই। এ লড়াইয়ে জেতেনি কেউ– না মাছটি না তিরমন।

এখানেই নাটকটির প্রকৃত সৌন্দর্য নিহিত। কারণ প্রাচ্য সর্বদা এভাবেই হার এবং জিতকে ভিন্ন নয়, বরং একই নৈসর্গিক ঐক্যে বাঁধতে চেয়েছে। তাই বড়শিতে স্বর্ণবোয়াল গেঁথেও পাড়ে তুলতে না পারার ব্যর্থতা নয় বরং বড়শিতে স্বর্ণবোয়ালটি গাঁথতে পারার আনন্দই উদ্বেলিত করে তোলে তিরমনকে। তিরমনের দাদা জনম মাঝি স্বর্ণবোয়াল শিকারের নেশায় চিরলি বিলের অতল গভীরে ডুবে মরে, তার ছেলে খলিশা মাঝি স্বর্ণ দ্যুতিময় বোয়ালটিকে দেখেছিল বটে, তবে বড়শিতে গাঁথতে পারেনি।

অন্যদিকে খলিশা মাঝির ছেলে তিরমন সেই মিথের মাছটিকেই পাড়ে তোলার মতো সাহস করে। যদিও শেষ পর্যন্ত পাড়ে তুলতে না পারলেও লড়াই চালিয়ে যেতে সে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির চিরন্তন গণিতে বাধা মানবসভ্যতা সর্বদা জয়টাকে বড় করে দেখলেও এখানে পরাজয়টাকে ‘পরাজয়ের’ মতো হীন চোখে না দেখে লড়াইয়ের মাঝেই জীবনের প্রকৃত সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে।

‘স্বর্ণবোয়াল’ প্রযোজনাটিতে সেট-লাইট-কস্টিউমসের ব্যবহারে পরিমিতিবোধ বিবেচনায় রাখা হয়েছে বলেই স্মরণ হয়। পোশাক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অভিনেতারা যেন সহজে মুভমেন্ট করতে পারেন সেদিকে খেয়াল রেখে নিকারি পাড়ার মানুষের সঙ্গে মাছ, মাটি, গাছ ও শ্যাওলা জলের নিবিড় সম্পর্ককে রঙের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সংগীতের সুচিন্তিত ব্যবহার দর্শককে বারবার নাট্যঘটনার গভীরে নিমজ্জিত করেছে এবং জীবনদর্শনের যে রূপ নাট্যকার নাটকটিতে স্পষ্ট করতে চেয়েছেন, তা আরও বেশি প্রকট করেছে। প্রযোজনাটি সম্পর্কে নির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্ক বলেছেন, “পথ মন্থনটাই যদি জীবন হয় তবে সে পথটা কোন পথ! রবিঠাকুর বলেছেন সব পথই পথ, যে পথ দিয়ে যাবেন ঠিক পৌঁছে যাবেন। যাঁরা পৌঁছেছেন তাঁরা স্বর্ণখচিত ‘বোয়ালটাকে’ নিশ্চিত দেখেছিলেন বলেই আমার বিশ্বাস। যারা দেখে না, তারা দেখে নাই। এমনই এক অনুধাবনজাত বিশ্বাস থেকে সেলিম আল দীনের ‘স্বর্ণবোয়াল’কে আমরা মন্থন করেছি। আমাদের প্রযোজনায় বাস্তব-বাস্তবতা, স্বপ্ন-স্বপ্নময়তা আমাদের নিমজ্জিত করেছে জীবন-সায়রের অতল গভীরে। সেখানে গীত, রূপকল্প, ভক্তি, প্রেম এক অভিনব নাট্যকল্পের উদ্ভাসনে আমাদের স্নান করায়।”