রাসেল মিয়া। একজন কবুতরপ্রেমী। বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলার আষাঢ়িয়ারচর। চাকরির পাশাপাশি শখের বসে কবুতর পালন করেন। কবুতর উড়ানোর প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তাঁর কবুতর ২০২২-২৩ সিজনে ১২৩ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

ছোটবেলায় রাসেল দেখতেন, আকাশে নানা রঙের কবুতরের ওড়াউড়ি। ভাবতেন, কবে তাঁর কবুতর এভাবে উড়ে বেড়াবে! ২০১৭ সালে শখের বসে কিছু কবুতর কেনার মাধ্যমে তাঁর কবুতর পোষার যাত্রা শুরু। অল্পদিনে তাঁর কবুতর বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ভালো ফলাফল করতে থাকে। বর্তমানে তাঁর কাছে আর্মি, পাংখি, বাঘা, সিলভার, জিরাগলা, খাকখি, সবুজ গলা, বাভরা, কাজকরা সুন্দরী, জাক গলা প্রজাতির প্রায় ৪৭ জোড়া কবুতর আছে। প্রতি জোড়ার দাম ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।

২০২৩ সালে ১২৩ কিলোমিটার প্রতিযোগিতায় তাঁর কবুতর চ্যাম্পিয়ন হয়। পুরস্কার হিসেবে তিনি পেয়েছেন ২৫ হাজার টাকা। এর আগে সোনারগাঁ উপজেলায় ৩০ কিলোমিটার প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তাঁর কবুতর। কবুতর নিয়ে রাসেলের জীবনের প্রথম প্রতিযোগিতা ছিল ২০১৯ সালে। ৩৫ কিলোমিটারের ওই প্রতিযোগিতায় সাতজনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় হন। পুরস্কার হিসেবে পান ১৫ হাজার টাকা।

২০২০ সালে ৫১ কিলোমিটার প্রতিযোগিতায় তিনি ৯ জনের মধ্যে হন দ্বিতীয়। এরপর ২০২১ সালে ২৫ কবুতর ৩১ কিলো ওপেন সাইড খেলায় তিনি পাঁচ শূন্যতে জয় লাভ করেন। এক সময় রাসেল হাটবাজার থেকে কবুতর সংগ্রহ করতেন। এখন নিজের কবুতর ব্রিড করান। যে বাচ্চাগুলো হয় তাদের ধীরে ধীরে উড়ানোর প্রশিক্ষণ দেন। উৎপাদিত অতিরিক্ত কিছু কবুতর বিক্রি করে খরচের জোগান হয় তাঁর। তবে দিন দিন কবুতরের খাবারের দাম বাড়াতে তিনি চিন্তিত।

কবুতরের রেস বাংলাদেশে নতুন নয়। তবে আগে অনেক কম হলেও, এখন রেস বেশি হচ্ছে। এটি বাংলাদেশে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিভাগ, জেলা এমনকি থানা পর্যায়ে রেসের আয়োজন হচ্ছে। এই রেসের জন্য কবুতরকে তৈরি করতে হয়। এই বিষয়ে রাসেল বলেন, প্রথমে ভালো জাতের বা ভালো ব্রিডের কবুতর সংগ্রহ করে তা থেকে বাচ্চা উৎপাদন করতে হবে। সেই বাচ্চাকে নিজ বাড়ি বা সেট ভালো করে চিনিয়ে দিতে হবে। পরে আস্তে আস্তে উড়াতে হবে। ৬ মাস থেকে ১ বছর উড়ানোর পর সাধারণত কবুতর টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার জন্য তৈরি হয়।

প্রতিযোগিতায় খেলার নিয়ম সম্পর্কে রাসেল মিয়া জানান, প্রথমে ক্লাবে একটা নির্দিষ্ট এন্ট্রি ফি জমা দিতে হয়। তারপর সেখান থেকে সবাইকে বলে দেওয়া হয় কোন দিকে বা কোন রুটে খেলা হবে। এই বছর দিক ছিল কুমিল্লা এবং ময়মনসিংহ। টস করে ময়মনসিংহ রুট পড়েছিল। পরে সদস্যদের ২০ থেকে ৩০ দিন সময় দেওয়া হয় কবুতরকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। নির্দিষ্ট তারিখটি ক্লাব থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়।

ওইদিন প্রতিযোগী কবুতরদের ক্লাব কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। ক্লাব থেকে গোপন নাম্বার রিং কবুতরের পায়ে লাগিয়ে দেয়। পরে গাড়িতে সবাই মিলে গন্তব্য স্থানে গিয়ে কবুতর ছেড়ে দেওয়া হয়। যার বেশি কবুতর বাড়িতে ফিরে আসবে, তিনি বিজয়ী বা চ্যাম্পিয়ন হবেন। গুগল ম্যাপে দূরত্ব হিসাব করা হয়। রাসেল বলেন, ‘এবার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন মোট ৯ জন। আমাদের এই খেলা হয়েছিল ময়মনসিংহ রোডে। ৯জনের মধ্যে আমার সবচেয়ে বেশি কবুতর ফিরে এসেছে। ৯টির মধ্যে চারটি কবুতর পথ চিনে ফিরে এসেছে। কবুতরের কারণে আমি চ্যাম্পিয়ন হয়েছি।’

রাসেল মিয়ার মতে, কবুতর উড়িয়ে যতটা না আর্থিক লাভ, তার চাইতে মনের শান্তিটাই আসল। তিনি বলেন, ‘কবুতর উড়িয়ে আমি মনে শান্তি পাই। যখন মন খারাপ থাকে, তখন কবুতরের কাছে গেলে আমার ভালো লাগে। আমি কবুতর ভালোবাসি। ওরাও আমাকে চেনে, ভালোবাসে। কাছে গেলে উড়ে এসে হাতে বসে।’ রাসেল কবুতরপ্রেমীদের সংগঠন সোনারগাঁ পিজন ফ্যান ক্লাবের প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

রেসিং কবুতরকে একটু শক্তপোক্ত হতে হয়। রাসেল এ জন্য তাঁর কবুতরকে ভালো খাবার দেওয়ার পাশাপাশি প্রাকৃতিক ওষুধ খাওয়ান। তিনি জানান, এতে কবুতরের শক্তি বাড়ে। উড়তে পারে ভালো। রাসেল বলেন, রেস করার আগে কবুতরকে প্রশিক্ষণ দিতে হয়। যে রাস্তায় খেলা, সেই রাস্তায় আস্তে আস্তে কবুতরকে সামনে দিকে নিয়ে যেতে হয়। তখন কবুতর রাস্তা দেখে বা নিশানা করে বাড়ি ফিরে আসে।

অনেক দূরে কবুতর ছেড়ে আসেন। সেই কবুতর যখন তার বাসায় ফিরে আসে, তখন রাসেলের খুব আনন্দ লাগে। রেস থেকে যখন কবুতর ফিরে আসে না বা কোনো কবুতর অসুস্থ হয়ে মারা যায়, তখন রাসেলের মন ভারাক্রান্ত হয়। তবে কবুতর উড়ানো তাঁর পেশা না হলেও, নেশায় পরিণত হয়েছে।