- সারাদেশ
- ভিন্ন ধারার দুই মৃৎশিল্প
ভিন্ন ধারার দুই মৃৎশিল্প

মানুষের প্রাচীনতম আবিষ্কারের একটি মৃৎশিল্প। যুগে যুগে খাবারের পাত্র, আসবাব ইত্যাদি তৈরিতে মৃৎশিল্পের ব্যবহার হয়ে আসছে বিভিন্নভাবে। কালের বিবর্তনে মৃৎশিল্পে আসছে নতুনত্বের ছোঁয়া, ভিন্ন ভিন্ন জিনিসপত্র তৈরির নিপুণ দক্ষতা। মাটির হাঁড়ি-পাতিল তৈরির প্রণালি অহরহ চোখে পড়লেও সেভাবে দেখা মেলে না ভিন্ন কিছু জিনিস তৈরির দৃশ্য। তেমনই দুটি ধারা– তন্দুরি চুলা ও নান্দনিক দইয়ের পাত্র তৈরি। এতেই জীবন পার করছেন কোনো কোনো কারিগর। লিখেছেন গাজী আনিস
দইয়ের পাত্রে আধুনিকতার ছাপ ঘুরছে চাকা। তার ওপর নিরেট মাটিতে শিল্প ফুটিয়ে তুলছেন কুমার। এভাবে কাদামাটির দলা থেকে মাথা ফুড়ে উঁকি দিচ্ছে ছোট ছোট দইয়ের পাত্র। তা তৈরি হচ্ছে রাজধানীর অদূরে কেরানীগঞ্জে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে একটু এগোলেই কেরানীগঞ্জের কুলচর আরশিনগর এলাকা। যেখানে নদীর কোলঘেঁষে তৈরি হয়েছে দইয়ের পাত্র তৈরির কারখানা। সেখানে দেখা মেলে দইয়ের পাত্র তৈরির নানা চিত্র। বিভিন্ন আকারের দইয়ের পাত্র তৈরি করছেন কারিগররা; যা পৌঁছে যায় দেশের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কোম্পানিগুলোতে।
সকাল থেকে দইয়ের পাত্র তৈরির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন কারিগররা। কেউ মেশিনে মিহি করেন মাটি, কেউ দলা বানান। কেউ বা চাকার ওপর ফেলে দইয়ের পাত্রের আকার দেন। আবার এগুলো শুকানো, রং করা ও পোড়ানোর কাজে ব্যস্ততা কারও কারও ক্ষেত্রে।
যুগের বদলে এখন অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রের মাধ্যমে ঘোরে কুমারের চাকা। এতে কাজের গতি ও উৎপাদন বেড়েছে অনেকাংশে। আগেকার দিনে হাতের মাধ্যমেই ঘুরে চলত এই চাকা। এখন অবশ্য বিদ্যুৎ না থাকলেও কারখানায় রয়েছে জেনারেটরের ব্যবস্থা।
কালের বিবর্তনে হারাতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। তবে এই শিল্পকে ধরে রাখতে পণ্যে অনেকেই দিচ্ছেন আধুনিকতার ছাপ। যেমন আধুনিকতা এসেছে এখানকার দইয়ের পাত্রগুলোতেও। দইয়ের পাত্রে এখন দেখা মেলে বিভিন্ন নকশা। চারপাশে থাকে কারুকাজ। অনেকে দই খাওয়া শেষে ছোট এই পাত্রগুলো ঘর সাজাতেও ব্যবহার করতে পারেন।
যাঁরা এই মাটির পাত্র তৈরি করেন সেই কারিগররা বেশ সম্ভাবনা দেখছেন এই খাতে। আব্দুস সোবহান নামে এক কারিগর বলেন, মিষ্টি জাতীয় খাবার বিক্রি করে এমন বিভিন্ন ব্র্যান্ড আমাদের কাছ থেকে দইয়ের পাত্র কেনে। বরিশালের কারিগর রেজাউল কাজ করেন এই কারখানায়। তিনি বলেন, আগেকার দিনে আমরা যে দইয়ের পাত্র তৈরি করতাম, তাতে খুব বেশি সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা যেত না। এখন ডিজাইনে
বৈচিত্র্য চলে এসেছে। দোকানে সাজানো থাকলেও দেখতে বেশ ভালো লাগে। আরেকটা বিষয়, মাটির দইয়ের পাত্রে যেমন দই জমাট বাঁধে, প্লাস্টিকের পাত্রে তেমন জমা হয় না।
তবে বেশ কিছু সমস্যার কথা উঠে আসে কারিগরদের কথায়। কারিগররা জানান, রাজধানীতে মৃৎশিল্পের উপযোগী মাটির সংকট রয়েছে। যেসব মাটি সংগ্রহ করা হয়, সেখানে ইট ও খোয়ার মতো শক্ত অনেক উপাদান পাওয়া যায়; যা মাটির জিনিস তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। পাশাপাশি মাটির দামও বেশ চড়া। সবকিছুর দাম বাড়লেও সে তুলনায় বাড়েনি মাটির এসব পাত্রের দাম। মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের পাশাপাশি কোম্পানিগুলোকে যথাযথ দাম দিয়ে পণ্য নেওয়ার আহ্বান সংশ্লিষ্টদের। তারা জানান, নির্দিষ্ট রেটেই কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য কেনে। সহজে দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই তাদের। এ ছাড়া দইয়ের পাত্র পোড়াতে লাগে কাঠের মতো উপাদান, যা সরবরাহ করাও অনেক ব্যয়বহুল। মূলত তিন থেকে চার রকমের দইয়ের পাত্র তৈরি হয় এই কারখানায়। ছোট পাত্রগুলোর দাম শুরু হয় ৬ টাকা থেকে। এ ছাড়া ১৫, ২০ টাকা দামের পাত্রও পাওয়া যায় এখানে।
তন্দুরি চুলার কারিগর রাজধানীর রায়েরবাজারের এক ঝুপড়ি ঘর। তার ভেতর মাটির গম্বুজ আকৃতির কিছুতে পেটাচ্ছেন মাঝ বয়সী একজন। কাকা কী করছেন, কী এগুলো– জিজ্ঞেস করতেই এক গাল হাসি। রসিক এই মানুষটা জানালেন, চুলা তৈরি করছেন। কীসের চুলা, কী কাজে লাগে বলার আগেই কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘ওই যে বাকরখানি, নান রুটি খান না? ওইগুলো যেখানে তৈরি হয়, সেই চুলা।’
কথায় কথায় জানা হলো মিশুক ও রসিক এই মানুষটার নাম পরান কৃষ্ণ পাল। ৩০ বছর ধরে তৈরি করছেন তন্দুরি রুটি, বাকরখানি, নান রুটি তৈরির চুলা। আগে ছিলেন দর্জি। কিন্তু অবসরে কুমারের কাজ করতে করতেই এই পেশায় কখন যে জড়িয়ে গেছেন নিজেও জানেন না। শুরুতে যাঁর সঙ্গে কাজ করতেন
তিনি বিদেশ চলে যাওয়ার পর এই কাজেই নিজেকে পূর্ণ মনোনিবেশ করেন।
রাজধানী ঢাকার রায়েরবাজারের শ্রী শ্রী আখড়া মন্দিরের কাছেই পরান কৃষ্ণের চুলা তৈরির দোকান। আশপাশে আছে আরও কয়েক কারিগরের দোকান। চুলা তৈরি করেন এমন এক নারী কারিগর সবিতা পাল জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর তিনিও ৩০ বছর ধরে এই পেশায়। রায়েরবাজারের এ কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একেকটি তন্দুরি চুলা বানাতে তাদের সময় লাগে প্রায় ১৫ দিন।
এই চুলা তৈরির ক্ষেত্রে বেশ কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। আগে থেকে সংগ্রহ করতে হয় লালমাটি। এরপর তা বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে প্রথমে চাকের মতো করে তুলতে হয়। মাটির দেয়াল তৈরির মতো একটি একটি করে ধাপে এগোতে হয়। এরপর বিশেষ পিটুনি দিয়ে চুলার গাঁথুনি ঠিক করা লাগে। চুলা থেকে অতিরিক্ত মাটি অপসারণ ও মিহি প্রলেপ দিয়ে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়। চুলা একটু শুকিয়ে এলে উল্টে দেওয়া হয়। চুলা শুকানোর জন্য ভেতরে আস্তে আস্তে আগুনের তাপ দেওয়া লাগে। ক্রেতার চাহিদা বেশি থাকলে একটু বেশি আগুনের তাপ দিয়ে দ্রুত শুকিয়ে ফেলা হয় চুলা।
সাধারণত গাজীপুর, টঙ্গী থেকে লাল মাটি সংগ্রহ করেন কারিগররা। আগে রায়েরবাজার এলাকায় লাল মাটি পাওয়া গেলেও সব জায়গায় বিল্ডিং তৈরি হওয়ায় এখন আর মাটি পাওয়া যায় না। পাশাপাশি মাটি সংগ্রহে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয় কারিগরদের। তাঁরা জানান, এখন বেশ দাম দিয়ে মাটি কিনতে হয়। আবার যেখানে মাটির চুলা তৈরি করেন, সেটিও ভাড়ার দোকান। তাই বেচাবিক্রি করে খুব বেশি লাভ করা সম্ভব হয় না। সবকিছুর দাম বাড়লেও মাটির চুলার দাম সেভাবে
বাড়ে না।
কারিগররা জানান, এক ট্রাক মাটি দিয়ে ছোট-বড় মিলিয়ে আটটি চুলা তৈরি করা সম্ভব। আকারভেদে একেকটি চুলা এক থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হয়। বড় চুলা এর বেশি দামেও বিক্রি করা যায়। অনেকে আগে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিয়ে যান। আবার ঘরের খাবার তৈরির জন্য কেউ কেউ ছোট ছোট চুলা বানিয়ে নেন। এখানকার চুলাগুলো শুধু দেশের ভেতরে নয়, দেশের বাইরে থেকেও অনেকে কিনে নিয়ে যান। তবে সে সংখ্যাটি অনেক কম। এর আগে পরান কৃষ্ণের তৈরি চুলা গেছে আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড, কোরিয়াতে।
মাটির তন্দুরি চুলার ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ শঙ্কিত কারিগররা। কারণ ধাতব চুলা এখন অনেকটা বাজার দখল করে নিচ্ছে। তবে লোহা কিংবা অন্য উপাদানে তৈরি চুলার বাকরখানি, তন্দুরি রুটিতে মাটির চুলার মতো স্বাদ মেলে না বলে জানান তারা। অন্যদিকে, এই পেশা টিকিয়ে রাখতে কেউ আগ্রহী নন বলে জানান তারা। সন্তানদের সবাই অন্য পেশায় রয়েছে বলে জানান পরান কৃষ্ণ পাল। তবে গায়ের শক্তি যতদিন সহায় হবে, পরান কৃষ্ণ পালসহ মাটির তন্দুরি চুলার কারিগররা চান এ পেশা টিকিয়ে রাখতে।
মন্তব্য করুন