ঢাকার উপকণ্ঠ নবাবগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রাম পানালিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা মাধুরী বণিক। ছোটবেলা থেকে তিনি স্বাধীনচেতা মানুষ। যে পরিবারে বড় হয়েছেন, সেটি ছিল রক্ষণশীল। তবে নারী হয়েও তিনি দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি।

২৫ বছর ধরে মাধুরী বণিক নিরলসভাবে নিজের সংগ্রহ করা বই পাঠকের বাড়ি বাড়ি দিয়ে আসেন এবং আগের বই ফেরত আনেন। এভাবে তিনি এক অভিনব পাঠাগার পরিচালনা করছেন ঢাকার অদূরে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে। নিজ গ্রামের পার্শ্ববর্তী বড় সংসাবাদ গ্রামে গাছতলায় শিশু-কিশোরদের নিয়ে পাঠশালাও গড়ে তুলেছেন তিনি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪তম জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে গতকাল ওই পাঠশালায় আয়োজন করা হয় শিশু-কিশোরদের রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং পুরস্কার বিতরণী। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত অনুষ্ঠানে শিক্ষাক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য মানপত্রসহ মাধুরী বণিককে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এ সময় মাধুরী বণিককে স্বাধীনতা পদক দেওয়ার দাবি তোলা হয়।
প্রতিযোগিতায় ৫০ শিশু-কিশোর অংশগ্রহণ করে। পুরস্কার দেওয়া হয় বিজয়ী ছয় শিশু-কিশোরকে। এ ছাড়াও সংগঠনের পক্ষ থেকে মাধুরী বণিককে পাঠাগার পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে রচিত ৬৫০টি বই, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে ১ লাখ ৩ হাজার টাকা এবং স্কুলের শিশুদের বই ও ছবি আঁকার সরঞ্জাম উপহার দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরীন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষাবিদ মমতাজ লতিফ, চারুশিল্পী আবুল বারক আলভী, নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল, লেখক আলী আকবর টাবী, শহীদসন্তান আসিফ মুনীর তন্ময়, আবৃত্তিশিল্পী শওকত আলী, নবাবগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মতিউর রহমান, কলাকোপা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও নবাবগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি ইব্রাহিম খলিল, স্থানীয় সাংবাদিক শওকত আলী রতন প্রমুখ। সভা সঞ্চালনা করেন নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির।

বিচারপতি মানিক বলেন, মাধুরী বণিক অনন্য। তাঁর কাজের মাধ্যমে তিনি যে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন, তা এ সময়ে বিরল।

শহীদজায়া শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী বলেন, শিশুদের মানস গঠনে মাধুরী বণিক ঘরে ঘরে মায়েদের কাছে বই পৌঁছে দেন। মায়েরা বই পড়ে শিশুদের জ্ঞান দান করেন। জাতি গঠনের জন্য এমন দৃষ্টান্ত এর আগে দেখিনি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে যদি এ রকম মহতী কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়িত রাখি, তাহলে অচিরেই বাংলাদেশ আরও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে।

শিক্ষাবিদ মমতাজ লতিফ বলেন, ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে আমাদের জাতিগত পরিচয় বড়। মাধুরী বণিক দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় ধরে এই অঞ্চলের অভিভাবক ও শিশুদের এ শিক্ষাই দিয়ে আসছেন। আমরা চাই রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁকে সম্মান জানানো হোক।

‘গাছতলার পাঠশালা’র প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষাদাত্রী মাধুরী বণিক বলেন, ‘আমি অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করি। ৬৯ বছর বয়স চলছে। এখনও ঘুরে ঘুরে এলাকার মায়েদের কাছে বই বিতরণ করি, যাতে তাঁরা তাঁদের সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারেন।’

নবাবগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মতিউর রহমান বলেন, মাধবী বণিকের মতো সবাই নিজ অবস্থান থেকে এমন মহতী কাজে এগিয়ে আসা দরকার।

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক শাহরিয়ার কবির বলেন, মাধুরী বণিকের এ অসামান্য অবদানের জন্য তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা, বিশেষ করে স্বাধীনতা পদক দেওয়া উচিত। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এক অনুষ্ঠানে ‘জয় বাংলা ও জয় বঙ্গবন্ধু’ বলার জন্য মাধুরী বণিককে লাঞ্ছিত করা হয়েছিল, কিন্তু তাঁকে দমিয়ে রাখা যায়নি। বহু অখ্যাত ও স্বাধীনতাবিরোধীকে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হলেও মাধুরী বণিকের মতো মানুষদের রাষ্ট্র এখনও মর্যাদা দিতে পারেনি।