পঞ্চগড়ে নারকীয় তাণ্ডবের ১৬ দিনেও ঘরে ফেরেননি আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন। তাঁরা এই সম্প্রদায়ের অফিস ও দুটি মসজিদে রাত কাটান। হামলাকারীরা আহমদ নগর উচ্চ বিদ্যালয়েও অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে। স্কুলের অফিসসহ বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষের চেয়ার-টেবিল পুড়িয়ে দেয়। আতঙ্কে কোনো ছাত্রছাত্রী এখনও স্কুলে আসে না। প্রধান শিক্ষকসহ ১২ জন শিক্ষক এবং দু’জন কর্মচারী স্কুল খুলে বসে থাকেন। স্কুল মেরামতেরও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এদিকে হামলার পর অনেক শিশু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেদিনের বীভৎসতা শিশুদের তাড়িয়ে বেড়ায়। এখনও শিশুরা হঠাৎ কেঁদে ওঠে। ক্ষতিগ্রস্ত কেউ কেউ দিনে আগুনে পুড়ে যাওয়া ভিটার পাশে বসে থাকেন। কেউ আবার ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করা শুরু করেছেন। এলাকায় পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন থাকলেও তাদের মধ্যে ভয় কাটেনি। শনিবার সকালে আহমদ নগর, ফুলতলাসহ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

আক্রান্তদের অনেকে ১৭ দিন ধরে এক কাপড়েই আছেন। কেউ আবার প্রধানমন্ত্রীর অনুদানের টাকায় কাপড়, বিছানার চাদরসহ কিছু কেনাকাটা করেছেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ফুলতলা গ্রামের ভাটাশ্রমিক আব্দুল হাফিজের স্ত্রী শাহানারা বেগম বলেন, ‘ছেলে ঢাকায় থাকে, সেখান থেকে কম্বলসহ কিছু কাপড় পাঠিয়েছে। সেগুলো রাখার জন্য দেড় হাজার টাকা দিয়ে একটি ট্রাঙ্ক কিনে আনলাম।’

পোড়া বাড়ির ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করছিলেন মনু মিঞা। তিনি বলেন, ‘স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ে নিয়ে মসজিদেই থাকি। ঘটনার দিন আড়াই বছরের নাতি সৌরভ অসুস্থ হয়ে পড়ে। ১৬ দিনেও তার জ্বর সারেনি। দিনে তাকে নিয়ে বাড়িতে এলে আঁতকে ওঠে, ভয়ে কান্না শুরু করে। কিন্তু কী করব, বাড়িতে না এলে ভালোও লাগে না। পুড়ে যাওয়া বাড়ির ভিটামাটিতে বসে থাকলেও কিছুটা শান্তি লাগে।’

ভাটা শ্রমিক আব্দুল হাফিজ জানান, বাড়ি-ঘরের সঙ্গে সবকিছুই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক সহায়তা হিসেবে ২৮ হাজার ৮১৬ টাকা পেয়েছেন। তবে এই টাকা দিয়ে কী হবে।

ফুলতলা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব কৃষি শ্রমিক মো. মমিনুল হক বলেন, ‘বাড়ির চারটি ঘরে ছয়জনের সংসার। চারটি ঘরই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শুধু রান্না ঘরটি কোনোমতে রক্ষা পেয়েছে। সেখানেই স্ত্রীসহ রাত কাটাই। পরিবারের অন্যরা মসজিদে থাকে। ঘরের প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা পেয়েছি ১৭ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে কীভাবে কী করব।’ ফুলতলা বাজারে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটে ক্ষতিগ্রস্ত ১৮টি দোকানের মধ্যে দু-একটিতে সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। বাজারের মুদি দোকানের মালিক নুর আলম জানান, তাঁর দোকানে প্রায় ১২ লাখ টাকার মালপত্র ছিল। সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুদান পেয়েছেন ৩৮ হাজার টাকা। সেই টাকা দিয়ে সংস্কার কাজে হাত দিয়েছেন।

আহমদ নগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জুয়েল প্রধান বলেন, স্কুলের ২৮০ শিক্ষার্থীর প্রায় অর্ধেক আহমদিয়া সম্প্রদায়ের। ভয়ে কেউ স্কুলে আসে না। মাঝে মধ্যে দু’একজন শিক্ষার্থী পরিস্থিতি দেখতে স্কুলে আসে। টেবিল, চেয়ারসহ অফিসে আগুন দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত সংস্কার কাজ শুরু করা যায়নি।

হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৭টি মামলা হয়েছে। মোট ২০১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুক্রবার ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে পলাতক একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ৩ মার্চ আহমদিয়া সম্প্রদায়ের তিন দিনব্যাপী বার্ষিক সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে সম্মিলিত খতমে নবুওয়াত সংরক্ষণ পরিষদ সমর্থক মুসল্লিরা বিক্ষোভ করেন। এক পর্যায়ে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোটা এলাকা। পুড়িয়ে দেওয়া হয় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের শতাধিক বাড়িঘর। সংঘর্ষে দুই যুবক মারা যান। রাত ৮টায় ঘোষণা দিয়ে জলসা বন্ধ করা হয়। পরদিন গুজব ছড়িয়ে আবারও হামলা চালানো হয়।