একের পর এক ফসলের আবাদ, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার ও উপরিভাগ কেটে নেওয়াসহ নানা কারণে ক্রমাগত পুষ্টিগুণ হারাচ্ছে মাটি। এতে ফসল উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। পাশাপাশি ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশ ও প্রতিবেশের। ঝিনাইদহ মৃত্তিকা গবেষণাগারের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা এমন তথ্য জানিয়েছেন। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন এবং মাটি পরীক্ষা করে সার ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলার ছয় উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মাটি ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে প্রয়োজনের তুলনায় কম মাত্রার পুষ্টি উপাদান পাওয়া গেছে। ফসল উৎপাদনের জন্য ১৭টি পুষ্টি উপাদান জরুরি। কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন ছাড়া সব উপাদান মাটি থেকে পাওয়া যায়। আটটি উপাদান ধান, পাট, সবজিসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদনে বেশি দরকার।

এখানে প্রতি ১০০ গ্রাম মাটিতে নাইট্রোজেন দশমিক ২৭ মাইক্রোগ্রামের পরিবর্তে রয়েছে দশমিক ০৯ মাইক্রোগ্রাম, যা অতি নিম্ন মাত্রার। ফসফরাস ২৩-৩০ মাইক্রোগ্রামের পরিবর্তে নিম্ন মধ্যম মাত্রার ১৫ থেকে ২২, পটাশিয়াম দশমিক ২৭ এর পরিবর্তে নিম্ন মাত্রায় দশমিক ১৮ মিলিতুল্যাংক, সালফার ২৭ মাইক্রোগ্রামের পরিবর্তে মধ্যম ২২ থেকে ৩০, জিংক ১ দশমিক ৩৫ এর স্থলে নিম্ন মাত্রায় দশমিক ৪৫ থেকে দশমিক ৯০ মাইক্রোগ্রাম রয়েছে।

পাশাপাশি বোরন দশমিক ৪৫ মাইক্রোগ্রামের পরিবর্তে উচ্চমাত্রায় দশমিক ৬১, অম্লমান ৬ দশমিক ৬০ থেকে ৮ দশমিক ৪০ যা নিরপেক্ষ মাত্রার এবং বেশি দরকারি জৈব পদার্থ রয়েছে ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১ থেকে ১ দশমিক ৭০ শতাংশ, যা অতি নিম্নমাত্রায় রয়েছে।
হরিণাকুণ্ডু উপজেলার বাসুদেবপুর গ্রামের কৃষক মো. শাহীন ভুট্টা চাষের জন্য এলাকার ভাগাড়ের মাঠের জমির মাটি পরীক্ষা করতে দিয়েছিলেন মৃত্তিকা গবেষণা ইনস্টিটিউটে। এতে ফসফরাস, পটাশিয়াম, জৈব পদার্থ নিম্ন, নাইট্রোজেন অতিনিম্ন, সালফার ও জিঙ্ক মধ্যম এবং বোরন অতি উচ্চ মাত্রার রয়েছে। আর অম্লমান মৃদু খার অবস্থায় আছে। তিনি বলেন, মাটি পরীক্ষা করে সার প্রয়োগের মাত্রা জানা যায়। এতে সারের অপচয় হবে না, ফলনও ভালো হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অপরিকল্পিত বাসস্থান বাড়ছে। যত্রতত্র কৃষিজমিতে বাসস্থান নির্মাণ করছে মানুষ। যে কৃষিজমি অবশিষ্ট থাকছে, সেখানে বছরে তিন থেকে চারটি, কোথাও পাঁচটি ফসলের আবাদ হচ্ছে। ফলে মাটির নির্ধারিত প্রাকৃতিক পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ ক্রমাগত কমছে। এ চাহিদা পূরণে রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন কৃষকরা।

হরিনাকুণ্ডু উপজেলার কিসমতপুর গ্রামের কৃষক লিয়াকত হোসেন বলেন, ধানের পাশাপাশি পাট ও গমের চাষ করেন তিনি। তবে কয়েক বছর ধরে অতিরিক্ত সার না দিলে জমিতে ভালো ফলন আসে না, উৎপাদন কমে যায়। আমন মৌসুমে এক বিঘা জমিতে ৩০ কেজি ইউরিয়া সার দিলে বোরো মৌসুমে ৪৫ কেজি প্রয়োজন হয়। অন্য সারও বেশি লাগছে। এতে খরচ বেড়ে যায়। সার কম দিলে ফসল অপরিণত থাকে, ফলন কমে।

কর্মকর্তাদের মতে, অনেক জমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হচ্ছে। নির্ধারিত পরিমাণের তুলনায় বেশি হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে সারের পারস্পরিক ভারসাম্যহীন পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এতে জমির ফসলের উৎপাদন কমে যায়। ক্রমাগত রাসায়নিক সার মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করলে একসময় এটিও আর কাজে আসবে না। অনেক ক্ষেত্রে উপকারী পোকামাকড় ও পাখির ক্ষতি হওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়ে পরিবেশে।

প্রতি বছর এক শ্রেণির প্রভাবশালী ভাটা মালিক নানা প্রলোভনে নামমাত্র দামে কৃষকের জমির উপরিভাগের মাটি কেটে নিচ্ছেন। এটি দিয়ে ইট তৈরি করে পোড়ানো হয়। না বুঝে নানা অজুহাতে কৃষকও বিক্রি করছেন মাটি। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, পাঁচ বছরে জেলায় আবাদযোগ্য কৃষিজমি কমেছে ৪ হাজার ৬৫৩ হেক্টর। চাষযোগ্য জমি রয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ২৩৫ হেক্টর।

বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা বলছেন, ঝিনাইদহ অঞ্চলের মাটিতে প্রাকৃতিক পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি রয়েছে। এজন্য একই জমিতে বছরে তিনের অধিক ফসল চাষ ও সারের অতিরিক্ত ব্যবহার বিশেষভাবে দায়ী। নাইট্রোজেন মাটিতে স্থায়ীভাবে থাকে না। এজন্য রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হলেও বেশি মাত্রায় দিলে ক্ষতি হয়। ফসল উৎপাদনের ১৭টির মধ্যে ১৪টি উপাদানই আসে মাটি থেকে। এর বেশির ভাগই থাকে মাটির ওপরে ৭ থেকে ৮ ইঞ্চির মধ্যে।

ওপরের মাটি কেটে ফেললে কমে যায় পুষ্টি উপাদান। এটি তৈরি হতে সময় লাগে ২৫ থেকে ৩০ বছর। টপ সয়েল তৈরিতে সময় লাগে এক হাজার বছর। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বাড়তি ফসলের উৎপাদনের প্রয়োজন হলেও রাসায়নিক সার পরিমিত মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে। অন্যথায় দীর্ঘমেয়াদে ফসল উৎপাদন কমবে। সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করা গেলে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, ফসলের উৎপাদনও বাড়বে।

ঝিনাইদহ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক গবেষণাগারের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোছা. শিখা নাসরিন বলেন, মাটির পুষ্টি উপাদান বজায় রেখে উৎপাদন বাড়াতে কৃষক সচেতনতা জরুরি। রাসায়নিক সার কমিয়ে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। এতে ফসলের দারকারি প্রায় সব উপাদান থাকে। জমি থেকে ফসল কাটার সময় নিচের কিছু অংশ রেখে দেওয়ার পাশাপাশি সবুজ সার চাষ করে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে জৈব সারের চাহিদা পূরণ করা যায়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা বিজয় কৃষ্ণ হালদার বলেন, বাড়তি রাসায়নিক সার ফসল উৎপাদনে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করছে। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টাও চলছে। এ পরিস্থিতিতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে সঠিক মাত্রায় সার ব্যবহার করতে হবে। জৈব সারে সব পুষ্টি উপাদান থাকলেও নাইট্রোজেন ও ফসফরাস কম থাকে। ফলে এগুলো বাইরে থেকে দিতে হয়।