শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার পশ্চিম নাওডোবা গ্রামের কৃষক আলতাব হোসেন। প্রতিদিনের মতো সীমানা এলাকায় বিল পদ্মার চরে বোরো ধান ক্ষেতে যাচ্ছিলেন। পথে বিকট শব্দ শুনে অনেকের মতো ছুটে যান তিনিও। গিয়ে দেখেন একটি বাস দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে। মধ্যবয়সী একজনকে বের করে আনেন তিনি। তখনও মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছিল। কিছুক্ষণ পর হাতের ওপর মৃত্যু হয় তাঁর। আলতাবের ভাষ্য, ‘এত বড় দুর্ঘটনা কোনোদিন দেখিনি।’

মাদারীপুরের শিবচরে রোববার সকালেও প্রতিদিনের মতো কর্মব্যস্ততা শুরু হচ্ছিল। দোকানি আবু আলী বাবুর্চি গ্যাসের চুলায় পানি গরম করে চা তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দে থেমে যায় সেখানকার কর্মব্যস্ততা। ছুটে যান কুতুবপুর সীমানা এলাকায় পদ্মা সেতুর অ্যাপ্রোচ সড়কে। সেখানে তখন শুধু মানুষের কান্না ও বাঁচার আকুতি। সে আকুতিও একে একে থেমে যাচ্ছিল।

রোববার শিবচরে ইমাদ পরিবহনের বাসটি দুর্ঘটনায় পড়ার পর সোয়া ৭টার দিকে সেখানকার পরিবেশ ছিল এমনই। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, শত শত বাসিন্দা মানুষগুলোকে রক্ষায় এগিয়ে আসেন। তবে সবাইকে বাঁচাতে পারেননি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনেকের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনার ১৫-২০ মিনিট পর পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস এসে উদ্ধার শুরু করে। দুর্ঘটনাস্থলে একে একে পাওয়া যায় ১৪ জনের লাশ।

প্রত্যক্ষদর্শী আবু আলী বাবুর্চি জানান, দুর্ঘটনাস্থল থেকে তাঁর দোকানটি ১৮-২০ গজ দূরে। শব্দ পেয়ে তিনিসহ স্থানীয়রা যাত্রীদের উদ্ধারের চেষ্টা করেন। চারদিকে তখন রক্তের স্রোত। যাকেই বের করা হচ্ছিল, তাঁরই মৃত্যু দেখতে হয়েছে। অনেকে দু-চার মিনিট কান্নাকাটি করে বা কথা বলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘মানুষ এভাবে মরে যায়, জীবনে প্রথম দেখলাম। রাতে মৃত ব্যক্তিদের কথা বারবার মনে পড়ছিল।’

বরিশালের হিজলা উপজেলার ভ্যানচালক মোহাম্মাদ ইসমাইল জাজিরার নাওডোবা গ্রামে পরিবার নিয়ে একটি বাড়িতে ভাড়া থাকেন। তিনি যাত্রী নামিয়ে দোকানে বসে খাবার খাচ্ছিলেন। তবে শব্দ শুনে খাবার রেখেই ছুটে যান। সঙ্গে থাকা ভ্যানচালক শহিদুলসহ স্থানীয়রা প্রথমে তিনজনকে বের করেন। তাঁরা সবাই মারা যান। বাসের পেছনের দিকে কয়েকজনের কান্নাকাটি শুনে জানালা ভেঙে ঢুকে এক নারী ও শিশুসহ পাঁচজনকে উদ্ধার করেন। সেখান থেকে তাঁদের ভ্যানে পাঁচ্চর রয়েল হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে শোনেন দু’জন মারা গেছেন।
শিকদার কান্দি গ্রামের আজাদ মাদবরের স্ত্রী আরজু বেগম সকালে রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। শব্দ শুনে সীমানা এলাকায় গিয়ে দেখেন, কয়েকটি লাশ সারি করে রাখা। ফুটফুটে একটি মেয়ের হাত-পায়ে আলতার মতো রক্ত লেগে ছিল। দোকান থেকে পানি নিয়ে তার মাথায় ঢালেন। সে শুধু মা মা বলে চিৎকার করছিল। তবে মাকে আর বাঁচানো যায়নি। এ বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ ভিজে আসে আরজুর।

এলাকার জামাল দর্জির স্ত্রী খাদিজা পারভিন জানান, শত শত মানুষ চেষ্টা করেছেন অসহায় মানুষগুলোকে বাঁচানোর। তবে জীবিত ছিল কম।

শিবচর ফায়ার সার্ভিসের টিম লিডার তরুণ রশিদ খান জানান, ঘটনাস্থলে ১৪টি লাশ পাওয়া যায়। জীবিত অবস্থায় ১০-১২ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। শিবচর হাইওয়ে থানার ওসি আবু নাঈম মোহাম্মাদ মোফাজ্জেল হক বলেন, উদ্ধার কাজে স্থানীয়রা অনেক সহযোগিতা করেছে। এ ঘটনায় রোববার রাতে মামলা হয়েছে।

রোববার ভোরে খুলনা থেকে যাত্রী নিয়ে ইমাদ পরিবহনের বাসটি ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। পথে পদ্মা সেতুর আগে ঢাকা-খুলনা এক্সপ্রেসওয়ের শিবচরের কুতুবপুর সীমানা এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে। আন্ডারপাসের গাইড ওয়ালে ধাক্কা লেগে দুমড়েমুচড়ে যায় বাসটি। এতে ঘটনাস্থলে ও পরে হাসপাতালে প্রাণ হারিয়েছেন ২০ জন।