- সারাদেশ
- হাসপাতালে বিনামূল্যে সেবা পানির জন্য লাগে টাকা
নোনাজলের কষ্ট - ২
হাসপাতালে বিনামূল্যে সেবা পানির জন্য লাগে টাকা

মাইশার বয়স দুই ছুঁই ছুঁই। ছোট্ট এ শিশুর ডান হাতের কবজিতে ক্যানুলা লাগানো। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার দু’দিন পর উঠে দাঁড়াতে পারছে সে। তবে মুখে কিছুই নিতে চাইছে না। শুধুই কান্না করছে। এখন এই শিশুটি খুলনার পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি রয়েছে।
মাইশার মতো এমন অনেক শিশু ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি। গত ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুধু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে নানা বয়সের ৭০০ মানুষ। এর মধ্যে শিশুই ৪৩০। চিকিৎসকরা বলছেন, বিশুদ্ধ পানির সংকটের কারণে প্রায়ই ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগের প্রকোপ লেগেই আছে। হাসপাতালে এসেও রেহাই নেই। এখানে সবকিছু বিনামূল্যে দেওয়া হলেও পানি কিনে খেতে হচ্ছে রোগীদের। হাসপাতালে অস্ত্রোপচার, হাত ধোয়া, রোগীর ব্যবহৃত থালা-বাসন, বিছানার চাদর ও পোশাক পরিষ্কারে ব্যবহার হচ্ছে লবণাক্ত ও আয়রণযুক্ত পানি।
মোংলা, শরণখোলা, দাকোপসহ উপকূলীয় এলাকার প্রায় ১৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একই অবস্থা। পৌরসভা কিংবা বেসরকারি সংস্থা থেকে পানি কিনলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে মেলে না অর্থ। আবার কিছু হাসপাতালে রিভার্স ওসমোসিস (আরও) মেশিন থাকলেও তা নষ্ট। মেরামতের জন্য মিলছে না অর্থ। ফলে রোগীরাই বহন করেন পানির খরচ।
অবশ্য পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অসহনীয় পানির কষ্ট দূর করতে ২০১৯ সালে ওয়াটারএইড বাংলাদেশের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় খাবার পানির ভেন্ডিং মেশিনসহ একটি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম চালু হয়। ‘নিরাপদ খাবার পানি সংগ্রহ কর্নার’ নামে এ বুথে দুই টাকার মুজিব কয়েন প্রবেশ করলেই বেরিয়ে আসবে দুই লিটার সুপেয় পানি। বুথ খোলা থাকে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। বাকি সময় দোকান থেকে বেশি দামে কেনা পানিতেই মেটে রোগীর তৃষ্ণা।
পানি নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই পাইকগাছা উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নীতিশ গোলকারের। তিনি বলেন, ১০টি ইউনিয়নের দৈনিক দেড় শতাধিক রোগী এখানে সেবা নেন। ডিপ টিউবওয়েলে পানি ওঠে না। ফলে রোগীকে টাকা দিয়েই পানি কিনে খেতে হয়। রক্ষণাবেক্ষণের কাজে এ টাকা ব্যয় হয়। পানির জন্য টাকা নিতে খারাপ লাগে; কিন্তু উপায় তো নেই। খরচ সামলাতে পানি কম খাওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি অসুস্থ হচ্ছেন নারী ও শিশুরা।
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ২০১৪ সালের দিকে পাইকগাছা পৌরসভা থেকে পানি কেনা হতো। তিন মাসের পানির বিলের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠি লিখলে অধিদপ্তর জানায়, পানির জন্য আলাদা বরাদ্দ নেই। পানির ব্যবস্থাপনা হাসপাতালের সম্পূর্ণ নিজস্ব। তখন পানির লাইন কেটে দেয় পৌর কর্তৃপক্ষ। এ অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা পরিকল্পনা ও বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পাইকগাছা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এ প্রকল্পকে মডেল ধরেও পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা মহিব উল্যাহ বলেন, পানির জন্য আমরা যুদ্ধ করছি। গ্রামে পানির জন্য প্রায়ই মারামারি হয়। কোনো একটি এলাকার টিউবয়েল কিংবা পুকুরে মিঠাপানি দেখা দিলেই মানুষ সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। অনেকে টিউবয়েলে তালা মেরে রাখে। একজনের পুকুরে আরেকজন নামতে পারে না।
ওয়াটারএইডের প্রোগ্রাম অফিসার (ইঞ্জিনিয়ারিং) ইয়াসিন অরাফাত বলেন, পাইকগাছা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ছাদ থেকে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে ফিল্টারিংয়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ট্যাঙ্কে রাখা হয়। ১০ হাজার লিটারের তিনটি ও তিন হাজার লিটারের তিনটি ট্যাঙ্কে ৩৯ হাজার লিটার পানি সংগ্রহ করা যায়। সরকার এমন পদ্ধতি সারাদেশেই চালু করতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা জানান, মোটরের মাধ্যমে দেশের সব হাসপাতাল ডিপ টিউবওয়েলের পানি তোলে। হাসপাতালের বার্ষিক বাজেট থেকে বিদ্যুতের বিল দেওয়া হয়। কিন্তু দেশের অন্য হাসপাতালের মতো মোটর দিয়ে পানি তোলা যায় না দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায়। সেখানে রোগীর খাবার বা ব্যবহার্য পানির জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে আলাদা বরাদ্দ নেই।
বাগেরহাটের মোংলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শাহীন বলেন, হাসপাতালের অন্য বাজেট থেকে পৌরসভাকে পানির বিল দিতে হয়। আলাদা কোনো প্লান্ট নেই।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকায় নলকূপ, পুকুরে বালুর ফিল্টার (পিএসএফ), রিভার্স ওসমোসিস প্রযুক্তি দিয়েছিল। কিন্তু অতিরিক্ত লবণ ও আয়রনের কারণে অনেক যন্ত্র নষ্ট হয়ে গেছে। খুলনার দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ফিল্টার মেশিন দীর্ঘদিন ধরে সচল নেই। ওয়াটারএইডের উদ্যোগে বসানো অনেক মেশিন লবণাক্ততার কারণে প্রায়ই নষ্ট থাকে। তা ঠিক করার জন্য অধিদপ্তরে লেখালেখি করেও অর্থ পাওয়া যায়নি। ফলে রোগীদের বাইরে থেকেই পানি কিনে খেতে হয়।
বাগেরহাটের শরণখোলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. প্রিয় গোপাল বিশ্বাস জানান, হাসপাতাল চত্বরে থাকা পুকুরের পানি মোটরের সাহায্যে সরবরাহ করা হয়। সেই লবণাক্ত ও আয়রনযুক্ত পানি বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। এ পানিতে ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু থাকলে রোগীর সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।
এদিকে, উপকূলীয় এলাকার হাসপাতালগুলোতে সুপেয় পানি নিশ্চিতের কাজটি কার– এ নিয়েও রয়েছে অস্পষ্টতা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (ক্লিনিক ও হাসপাতাল) ডা. শেখ দাউদ আদনান বলেন, উপকূলীয় এলাকায় পানির চাহিদা স্থানীয় সরকারই পূরণ করে। সুপেয় পানি নিশ্চিতে স্বাস্থ্য বিভাগের কার্যক্রম নেই।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের খুলনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বাহার উদ্দিন বলেন, নতুন একটি প্রকল্প এসেছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমেও সুপেয় পানির সমস্যার সমাধান করা যাবে।
গ্লোবাল অ্যাকশন এগেইনস্ট প্রোভাটির (জিক্যাপ) জাতীয় সমন্বয়কারী আবদুল আউয়াল বলেন, দেশের একেক এলাকার প্রকৃতি একেক রকম। রোগেও আছে ভিন্নতা। লবণাক্ত উপকূল, হাওর, পাহাড় ও সমতলের জন্য আলাদা পরিকল্পনা এবং বরাদ্দ নিতে হবে। বিশেষ করে উপকূলীয় লবণপ্রবণ এলাকায় পানির জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে নতুন করে ভাবতে হবে।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, উপকূলীয় ১০ জেলায় নিরাপদ বৃষ্টির পানি সরবরাহ করতে ৯৬১ কোটি ৭৫ লাখ ৫২ হাজার টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে ২২২টি ইউনিয়নের মানুষ এর সুফল পাবে।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, সম্প্রতি এনআইএইচআর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ সেন্টার ফর নন কমিউনিকেবল ডিজিজেস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল চেঞ্জ নামক গবেষণা সেন্টার চালু হয়েছে। সেন্টারটি খুলনার কয়রা ও সাতক্ষীরার আশাশুনিতে লবণাক্ততার ক্ষতি কমাতে কাজ করবে। উপকূলীয় এলাকায় পানির বিষয়টি আগামী বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হবে।
আরও পড়ুন
মন্তব্য করুন