বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়েছে নারী-পুরুষের সমন্বয়ে বহুমুখী অবদানের দ্বারা– এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীসহ এ দেশীয় তাদের দোসরদের সহযোগিতায় নিরীহ নিরস্ত্রসহ সকল শ্রেণি-পেশার বাঙালির ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে অত্যাচার-নির্যাতন হত্যার মাধ্যমে আতঙ্ক, ত্রাস, ভয়ভীতি সৃষ্টি করে, অরাজক অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করে। শুরু হয় যুদ্ধ। হানাদার পাকিস্তানি হায়েনার দল কাপুরুষের পরিচয় দেয়। সাধারণ মানুষ অতর্কিত এ হামলায় দিগ্বদিকশূন্য ও দিশেহারা হয়ে যে যেদিকে পারে বাঁচার তাগিদে সে সেদিকেই এলোমেলোভাবে ছোটাছুটি করে। ঘরবাড়ি, জিনিসপত্র, সম্পদ ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে নিজের জান নিয়ে এক কাপড়ে কোনোমতে বেরিয়ে পড়ে।  
অধিকাংশ পুরুষ মানুষ, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধগণ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বের হয়ে পড়েন। তাঁরা প্রতিবেশী বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারতসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বাড়িতে অবস্থানরত বাঙালি নারীরা সেই সমস্ত মুক্তিসেনাকে খুবই সতর্কতার সঙ্গে আশ্রয় দিয়েছেন, পরম মমতায় রান্না করে সাধ্যমতো খাবারের ব্যবস্থা করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছেন, প্রেরণা দিয়েছেন, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা প্রদান করেছেন, তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন, নিজের জীবন-মরণ হাতে নিয়ে গোপনে তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছিয়েছেন, বিভিন্ন অজুহাতে পাকিস্তানি হানাদারদের ক্যাম্পে গিয়ে তথ্য এনে তা মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করেছেন। বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে– ছদ্মবেশ ধারণ করে তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছেন–যার দরুণ মুক্তিযুদ্ধ অনেকটাই সহজ ও নিরাপদ হয়েছে। (পরবর্তী সময়ে এজন্য অনেককে বিভিন্ন ধরনের কঠিন শাস্তিও পেতে হয়েছে)। এই তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে নারীকে সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে । তাঁরা অধিকাংশই ছিলেন অজ পাড়াগাঁয়ের লেখাপড়া না জানা অতি সাধারণ নারী।      
মুক্তিযুদ্ধকালীন বাঙালি নারীদের অনেকেই পাকিস্তানি হায়েনা হানাদার বাহিনীসহ এ দেশীয় তাদের দোসরদের দ্বারা অবর্ণনীয়, পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন– তাঁদেরই একজন শেরপুরের আলেয়া বেগম। আলেয়া বেগম ধরা পড়ার পর ক্যাম্প থেকে পালানো কোনোভাবেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। মাঝে মাঝে অনেক চেষ্টা করেছেন পালাতে, পারেননি। মনে মনে কয়েকবার মরার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু কীভাবে মরবেন? গলায় ফাঁস  দেবেন, সে রকম কোনো কাপড় ছিল না। পাকিস্তানিরা তাদের একটা পাঞ্জাবি দিয়েছিল পরার জন্য। আর কোনো কিছু পরতে দেয়নি। এই একটা পাঞ্জাবি পরেই তিন মাস ছিলেন। আর বিষ খেয়ে মরবেন, কোথায় পাবে বিষ। খুব বেশি কষ্টের মাঝে ছিলেন তিন মাস। কোনোকিছু করার কোনো সুযোগই ছিল না। বন্দি থাকার যে কত কষ্ট, তা অন্য কারও পক্ষে বোঝানো সম্ভব না। যে বন্দি ছিল কেবল সে-ই বুঝতে পারে তার কষ্টের কথা। কত রকমের কষ্ট যে দিয়েছে তা বলে শেষ হবে না। যুদ্ধের একবারে শেষ সময়ে হাত-পা বেঁধে একটা মাটির বাঙ্কারের মধ্যে ফেলে দিয়েছে– যেখান থেকে বেঁচে উঠে আসা একেবারেই অসম্ভব ছিল। অতিরিক্ত নির্যাতনের ফলে আলেয়ার অবস্থা খুব বেশি খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
দেশ স্বাধীন হলে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এসে তাঁকে উদ্ধার করেন। তাঁরা হলেন– তাজ উদ্দিন, ফিরোজ মিয়া, আবিদ আলী। তাঁরা তাঁকে ক্যাম্পের বাঙ্কারের ভেতর থেকে উদ্ধার করেন। সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে যান, চিকিৎসা করিয়ে পরে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। বাড়িতে এসে দেখে আরও কত রকমের সমস্যা। মা-বাবাসহ বাড়ির কাউকে পায়নি। কেউ বলতেও পারেনি যে তারা কোথায়। তখন আশেপাশে প্রতিবেশীদের বাড়িতে থাকতে থাকে। তাঁরা আলেয়াকে আশ্রয় দিয়েছেন, আবার দশ কথা শোনাতেও কোনো রকমের চিন্তাভাবনা করেননি। দেশ স্বাধীন হলো। তাঁকে মুক্ত করে পৃথিবীর আলো-বাতাসে ফিরিয়ে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। দিন যাচ্ছে মোটামুটি, এরই মাঝে আলেয়া অনুভব করতে পারছেন, তাঁর শরীরের পরিবর্তন। প্রথমে বুঝতে পারেননি যে, এটা কিসের পরিবর্তন। একসময় বুঝতে পারেন এবং এক সময় জন্ম হলো একটি পুত্রসন্তান। তারপর তো বুঝতেই পারছেন, তার অবস্থা যে কী হতে পারে। কুমারী মায়ের কোলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সন্তান। মানুষ বলে না মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা, তাঁর হলো এই অবস্থা। এলাকার মানুষের এমন একটা ভাব, যেন আলেয়া কোনো মানুষ না। যে যেভাবে পারে, সে সেভাবেই তাঁকে নানান কথা শোনাচ্ছে।
এই সন্তানের বাবা কে– তা আলেয়া নিজেও জানেন না। আলেয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা নির্যাতিত। কিন্তু আলেয়া যে ইচ্ছে করে ধরা দেননি, এটাও তো সত্যি। কোনো সত্যিই তখন কাজ করেনি– মানুষ এমন ছি! ছি! করছে। তার পরও তো আলেয়া মা, তাঁর পেটে এসেছে এই ছেলে, কী করে ফেলে দেবে। অনেক চেষ্টা করেও ফেলতে পারেননি। একটা সময় আলেয়া মনে মনে ঠিক করেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে হলে, এই ছেলেকে বাঁচাতে হবে। আলেয়া তাকে বড় করবে। জীবন তো তাঁর শেষ-ই। ছেলেকে ধরেই আলেয়া বেঁচে থাকবেন। না, আলেয়ার আর বিয়ে হয়নি। হয়নি না, কেউ আর আলেয়াকে বিয়ে করেনি। কারণ তো স্পষ্টই, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে আলেয়া ধরা পড়ে। তারা আলেয়াকে তুলে নিয়ে যায় তাদের ক্যাম্পে। আটকে রেখে দিনরাত শত শত পাকিস্তানি সেনা তাঁর ইজ্জতহানি করেছে, যার ফলে আলেয়ার সন্তান এলো। এমন মেয়েকে কি কেউ বিয়ে করবে। তাই আর বিয়ে হয়নি।   
আরেক পাশবিক নির্যাতনের শিকার চেংসামা মারমা। যুদ্ধ শুরুর দুই-তিন মাস পর চেংসামা মারমাকে ধরে সরাসরি পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে নিয়ে একটা ঘরের ভেতরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। বাইের থেকে দরজাটা আটকে দেয়। সারাদিন ওই ঘরের ভেতরেই রাখে। সেই ঘরে আর কেউ ছিল না। সন্ধ্যার আঁধার যখন নেমে এসেছে তখন দরজা খুলে একজন মিলিটারি এসে চেংসামাকে নিয়ে যায় অন্য একটি ঘরে। দেখে, সেই ঘর ভর্তি মিলিটারি। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে কেউ বসে আছে, কেউ গল্প- হাসাহাসি করছে। সবাই আনন্দ-উল্লাসে মেতে আছে। তারা সবাই এক এক করে চেংসামাকে নির্যাতন করে। এভাবেই কেটেছে সারারাত। রাত শেষ হলে যখন ভোরের অল্প আলো ফুটছে তখন তাঁকে অন্য এক ঘরে নিয়ে যায়। তারা ক্লান্ত হয়ে শান্তিতে আরামে ঘুমাচ্ছে। প্রথমে যে ঘরের ভেতরে রেখেছিল সেই ঘরে নেয়নি, অন্য ঘরে নিয়ে রেখেছে।
সেই ঘরের ভেতর ছিল আর একটা জগৎ। মনে হয় ৪০ থেকে ৪৫ জন নারী। ১২-১৩ বছরের কিশোরী থেকে শুরু করে মনে হয় ৭০-৭৫ বছরের বৃদ্ধাও ছিল। শুধু আদিবাসী-ই ছিল না, বাঙালিও ছিল। ছোট একটা ঘর, তার ভেতরে এতগুলো মানুষ। নেই কোনো আলো-বাতাস। দম বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার মতন অবস্থা। খাবার দিত না ঠিক মতন। গোসলের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। রাতভর এমন নির্যাতনের পর শরীরে কোনো শক্তি থাকত না। পরের রাতও একইভাবে যেত।
রাতের শুরুতে তাঁকে নাচতে বলত। অর্ধেক রাত পর্যন্ত নাচতে হতো। বন্দি রেখে নাচতে বলত, নাচ কি আসে। তার পরও তো তাদের সকল চাহিদা মেটাতে হতো, না হলে যে রক্ষা নেই। প্রায় প্রতি রাতেই নাচতে হতো, অর্ধেক রাত নাচতে হতো। তারপর বাকি রাত চলত তাদের নির্যাতন। এভাবে কেটেছে ছয়-সাত মাস, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত। দেশ স্বাধীন হলে চেংসামা মারমারা ছাড়া পায়।
ছাড়া পাওয়ার পর বাড়িতে ফিরে আসে। তত দিনে তো সবাই জেনে গিয়েছে চেংসামার কথা। এলাকাবাসী ভালোভাবে নেয়নি। তাঁকে দেখলেই মোটামুটি সবাই, ছোট-বড় নানান জনে নানান কথা বলে। এত আজেবাজে কথা বলে, যা শোনা যায় না। আর সকলের এমন একটা ভাব যে, চেংসামা বুঝি ইচ্ছে করে ধরা দিয়েছিল মিলিটারিদের কাছে। আবার অনেকে কু-ইঙ্গিত করেও কথা বলে। তাদের কথায় রাজি না হওয়াতে খুব আজেবাজে কথা বলে। একে তো ছয়-সাত মাস বন্দি অবস্থায় শত শত মিলিটারির নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তারপর যখন ছাড়া পেলেন, তখন এলাকার লোকজন এমন নিষ্ঠুর আচরণ করত, কোনোভাবেই এসব মেনে নিতে পারতেন না। কিন্তু সহ্য করা ছাড়া তো চেংসামার কোনো উপায়ও ছিল না। মাঝে মাঝে চেংসামার মনে হতো মরে যাবেন। কিন্তু বললেই তো আর মরে যাওয়া যায় না।  
দেশ স্বাধীন হয়েছে। ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হচ্ছে কিন্তু চেংসামার বিষয়টা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। নানান জনের কথা বলা বন্ধ হচ্ছে না। তখন এলাকার দুই-চারজন ভালো বয়স্ক যারা, তাঁরা বলেছেন, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দাও, তাহলে হয়তো মানুষের মুখ বন্ধ হবে। মেয়েটারও একটা ঠিকানা হবে। মেয়ে মানুষ বিয়েশাদি না হলে, মা-বাবা না থাকলে কে দেখবে। ভাইয়েরা কতদিন দেখবে। একটা সময় তারও বয়স হবে, তখন কাজকর্ম করতে পারবে না। তখন কে তাকে খাওয়াবে, পরাবে। এমন সব কথা বলেছে সবাই। কেউ কেউ আবার পাত্রও খুঁজেছে। কেউবা দুই-একটা বিয়ের প্রস্তাব এনেছে। চেংসামাকে দেখেছে, পছন্দও হয়েছে। কিন্তু যখনই তাঁর ওই ঘটনা শোনে তখনই কেউ আর বিয়ে করতে রাজি হয় না। এমন অনেক বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, পছন্দও করেছে চেংসামাকে। কিন্তু ওই কারণে বিয়ে ভেঙে গিয়েছে। আর বিয়ে হয়নি। একা ছিলেন, একাই থেকে গিয়েছেন। মা-বাবা সবাই চলে গিয়েছে পরপারে। চেংসামা শেষ পর্যন্ত এক ভাইয়ের আশ্রয়ে আশ্রিতা হয়ে আছেন।    
মুক্তিযুদ্ধকালীন পাশবিক নির্যাতনের আরেক শিকার লিপি (ছদ্মনাম)। দেশ স্বাধীন হওয়ার দুই-তিন বছর পর লিপির বিয়ে হয়। যার সঙ্গে লিপিকে বিয়ে দিয়েছে, তার বয়স লিপির চেয়ে ১৪-১৫ বছরের বড়। তার ঘরে প্রথম পক্ষের স্ত্রী-সন্তান সবই আছে। সতিনের ঘরে বিয়ে হয়েছে। সতিনের তিন সন্তান আছে। সতিনের ছেলেমেয়েরা বড় বড়। তাদের অত্যাচারের কথা কী আর বলবে। সতিনসহ তার ছেলেমেয়েরা কতবার যে লিপিকে মেরেছে। বিয়ের বয়স যখন দুই বছর, তখন লিপির স্বামী মারা যায়। এ সময় লিপির সতিন আর তার ছেলেমেয়েরা লিপিকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। ফিরে আসে বাবার বাড়িতে। বাবার বাড়িতে এসে দেখে, এখানকার অবস্থাও ভালো না। সাগর থেকে মহাসাগরে পড়ে যায়। মা-বাবা, ভাই-বোন ছাড়া কেউ তাঁকে গ্রহণ করছে না। এমনকি বাড়ির অন্যেরা এবং গ্রামের লোকজন লিপির বাবা-মাকে এই বলে হুমকি দিচ্ছে যে, লিপি যদি তার বাবার বাড়িতে থাকে তাহলে তার মা-বাবা, ভাইবোনসহ তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। তাদেরকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। তখন মা-বাবাও চুপ হয়ে যায়। তার একার জন্য সবাইকে বাড়িছাড়া, ঘরছাড়া হতে হবে। এতগুলো মানুষ কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে, কে এতগুলো মানুষকে আশ্রয় দেবে। নিজের চোখে দেখছে, মা-বাবা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তখন লিপি নিজেই একা একা বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। কত জায়গায়, কত জনের কাছে আশ্রয় চেয়েছিলেন, কাজ চেয়েছিলেন কিন্তু কেউ তাকে কোনো আশ্রয় বা কাজ কোনোটাই দেয়নি। দিয়েছে শুধু অপমান, লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা। মরে যাবে, তাও তিনি পারছেন না। অনেকবার মরতে গিয়েছিলেন, যখনই মরতে যেতেন তখনই ছেলের মুখটা ভেসে উঠেছে। তাই আর মরতেও পারেননি।  
শেষমেশ লিপিকে আশ্রয় দেয় এক যৌনপল্লি। এত বড় দেশে, এত জায়গা থাকতে লিপির কোনো জায়গা হলো না। সবাই লিপিকে তাড়িয়ে দিয়েছে, কেউ আশ্রয় দেয়নি। যৌনপল্লি লিপিকে শুধু আশ্রয়ই দেয়নি, তিন বেলা খাবারসহ সব দিয়েছে।
লিপির কথা, ‘আপনাদের লজ্জা লাগছে আমার কথাগুলো শুনতে। আমার কিন্তু কোনো লজ্জা লাগেনি বলতে। কারণ, আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমি শুধু বলছি। আমার কথায় আপনারা লজ্জা পান। কিন্তু আমার দুঃখকষ্ট তো কেউ বুঝে না। যদি বুঝত, তবে কেন আমার আশ্রয় হলো না আপনজনদের কাছে। কেন আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো, বলতে পারেন?’  
পাশবিক নির্যাতনের শিকার আরেক আলেয়া বিবি
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লার আলেয়া বিবি ধরা পড়েন পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে। যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ১৪-১৫ বছরের কিশোরী। যুদ্ধের সময় আলেয়া বিবাহিত ছিলেন না, বিয়ে হয়েছে আরও পরে। আলেয়া বিবির মুখ থেকে শুনেছিলাম যুদ্ধ, ১৯৭১ তাঁকে কীভাবে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে– সেই বৃত্তান্ত।
“দেশ স্বাধীন হলো। এর বেশ কয়েক দিন বাদে আগরতলার ডাক্তাররা আমাদের জানালেন, আমরা এখন দেশে ফিরতে পারব। আমার মা-বাবাকে তাঁরা বললেন, ‘তোমাদের মেয়ে এখন অনেকটা ভালো। এখন তোমরা তাকে নিয়ে যাও। ওখানকার হাসপাতালে ভর্তি করে দিও।’   
‘আগরতলা হাসপাতাল থেকে সরাসরি কুমিল্লা সদর হাসপাতালে চলে এলাম। বাড়ি যাইনি। কুমিল্লা হাসপাতালেও দীর্ঘদিন থাকতে হয়েছিল। আমার বাঁ হাতটা তখন একেবারেই পঙ্গু। হাড়ের মাঝখান দিয়ে গুলি চলে যাওয়ায় অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে। চিকিৎসায়ও ফল হয়নি।’
‘অতঃপর বাড়ি ফিরে এলাম, আমার নিজ গ্রামে। শত দুঃখের মধ্যেও এটুকু আনন্দ যে, দেশ এখন স্বাধীন। ভাবি, নিজের মান গিয়েছে, হাত গিয়েছে, শরীরজুড়ে ক্ষতবিক্ষত, তাতে কী, দেশ তো স্বাধীন। আমিও স্বাধীন। আর দশজনের মতন করে আমিও থাকব। কিন্তু না, আমার জন্য দেশ স্বাধীন হয়নি। কারণ, আমি যে কলঙ্কিনী! আমার নামের আগে এখন আরও একটা শব্দ যোগ করা হয়েছে, বীরাঙ্গনা। আর এই বীরাঙ্গনা নাম হওয়াতে সবাই আমাকে ঘৃণা ও নিন্দা করতে শুরু করল। বাড়ির চারপাশের লোকেরা থুতু ছিটাতে থাকল। এমনকি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে অনেকেই আজেবাজে কথা বলত।’
“বিয়ে বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে আমার বাড়ির লোকদের দাওয়াত দেওয়া হলে তাদের আগে থেকে বলে দেওয়া হতো, আমাকে যেন না নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ, শুভকাজে আমাকে নিলে সব অশুভ হয়ে যাবে। মোট কথা, স্বাধীন বাংলাদেশে সমাজের চোখে তখন আমি ‘খারাপ’।”
‘গ্রামের কয়েকজন মুরুব্বি মা-বাবাকে বললেন, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দাও। কিন্তু আমাকে যে কেউ বিয়ে করতে আসে না। দূর থেকে যেসব বিয়ের প্রস্তাব আসে, আমাকে দেখে মোটামুটি পছন্দ হয়। কিন্তু গ্রামের লোকজন যখন আমার অতীত ঘটনা বলে, তখন পাত্রপক্ষ ফিরে যায়। বিয়ে করতে রাজি হয় না কেউই।’  
একসময় দেশ স্বাধীন হলে সেই নারীদেরকেই শ্বশুরবাড়ির লোকজন থেকে শুরু করে নিজের বাড়ি, সমাজ তাঁকে গ্রহণ করেনি। তখন তাঁকে পাহাড়, জঙ্গল, যৌনপল্লিতে আশ্রয় নিয়ে জীবনযাপন করতে হয়েছিল।  
গ্রামের সেইসব খেটে খাওয়া সাধারণ নারীরা একসময় আর ঘরে বসে না থেকে ছুটে গিয়েছেন পুরুষদের পাশাপাশি অস্ত্রহাতে যুদ্ধ ক্ষেত্রে। অনেকে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আবার অনেকে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। অনেকে ভারতে শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়ে সেখানে শরণার্থীদের বিভিন্নভাবে সেবা প্রদান করেছেন। যেমন– নার্সিং, স্বেচ্ছাসেবী ইত্যাদি। অনেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিজেদের নিয়োজিত করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে উজ্জীবিত করেছেন। যেমন– উদ্দীপনামূলক বিভিন্ন গান– চরমপত্র পাঠ-নাটিকা প্রচারসহ যুদ্ধক্ষেত্রের খবর প্রচারের মাধ্যমে।
দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশে অবস্থান করে এবং ভারতে আশ্রয় নিয়েও বাঙালি নারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন– যা বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।