রংপুর সিটি বাজারে কেনাকাটা করতে এসেছিলেন খটখটিয়া এলাকার মাহমুদ আলী। ছোলা, চিনি, তেল, ডাল ও বেসন কিনলেও তা ছিল চাহিদার অর্ধেক। দুটি ব্যাগ আনলেও একটি ভরতেই টাকা শেষ। মাহমুদের ভাষ্য, আগে দাম কম থাকায় ইচ্ছামতো কিনতেন। এখন বাজার অনিয়ন্ত্রিত; আয়ও বাড়ছে না। আগে তিন কেজি খেজুর কিনলেও এখন এক কেজিও কেনা যাচ্ছে না।

নীলকণ্ঠ এলাকার ভ্যানচালক সাজু মিয়া রোজা শুরুর আগে বৃহস্পতিবার কেনাকাটা করতে এসেছিলেন। তবে জিনিসপত্রের দাম দেখে কণ্ঠে ঝরে পড়ল আক্ষেপ। তিনি বলছিলেন, ‘যে দাম তাতে আর জীবন বাঁচে না। কী আর কইম বাহে, এবার বুজি হামার রোজায় থাকা হবার নয়!’

রমজানে প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে মাহমুদ ও সাজু মিয়ার মতো নিম্ন আয়ের মানুষ জমানো কিছু টাকা নিয়ে বাজারে এলেও খুশি মনে ফিরতে পারছেন না। বাড়তি দামের কারণে মাছ-মাংস কেনার আশা ছেড়েছেন আগেই। শাক-সবজি কিনতে গিয়েও ফেলতে হচ্ছে দীর্ঘশ্বাস।

ছোট ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের অভিযোগ, বড় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় ক্রেতাদের ওপর ধকল যাচ্ছে। যদিও বাজার তদারকি করছেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। মূল্য তালিকা না রাখায় সতর্ক ও বেশি দামে পণ্য বিক্রি করায় জরিমানা করা হচ্ছে। তবে স্বস্তি ফিরছে না বাজারে।
বাজার ঘুরে জানা গেছে, এবার ৮-১০ ধরনের খেজুরের চাহিদা বেশি। গত বছর প্রতি কেজি আজওয়া ৪০০ টাকায় বিক্রি হলেও এবার পাইকারি ৭০০ ও খুচরা ৭৫০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম ১১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ফল ব্যবসায়ী এখলাস উদ্দিন বলেন, আগে আড়তদারকে ১ লাখ টাকা দিলে ৩-৪ লাখ টাকার পণ্য নেওয়া যেত। এখন যে পরিমাণ টাকা, তার সমান পণ্য দেয়। আমদানি কম, খরচ বেশি। এলসি জটিলতা ও আমদানি শুল্ক বেড়ে যাওয়ায় দাম ঊর্ধ্বমুখী।

৯০ টাকা কেজি ছোলা বিক্রি হলেও সরকার নির্ধারিত দামে মিলছে না চিনি। খোলা দেশি চিনি ১৩০ টাকা কেজি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতীতে রমজানের আগে বেচাকেনা বাড়লেও এবার ক্রেতার ভিড় কম, কিনছেনও কম। গরুর মাংস ৭০০ ও খাসির মাংস ১ হাজার টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। ব্রয়লার মুরগি কিনতে হচ্ছে ২৫০-২৬০ টাকায়।

গত সপ্তাহে গরু ৬৫০, খাসি ৯০০ ও ব্রয়লার মুরগি ২৪০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, মুরগির সরবরাহ রমজানে বাড়বে। তবে দাম কমার সুযোগ নেই। সোনালি ৩৫০-৩৬০ ও দেশি মুরগি ৫০০-৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাছের দামও ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

বাজারে দেখা গেছে, ধনিয়া পাতা, ফুলকপি, মটরশুঁটিসহ সবজির দাম ঊর্ধ্বমুখী। কমেছে রসুন ও শজনে ডাঁটার দাম। চাল-ডাল-তেলের দাম অপরিবর্তিত। আগের সপ্তাহের ২৫ টাকার টমেটো এখন ৩০; ২৫ টাকার গাজর ৩০; ২০ টাকার শসা ২৫-৩০; ২০ টাকা বেড়ে চিকন বেগুন ৪০; ৩০ টাকার বেগুন ৬০; ১৫ টাকার পেঁপে ২০; ২০ টাকার লেবু (হালি) ৩০; ৮০ টাকার কাঁচামরিচ ১০০; ৪০০ টাকার শুকনো মরিচ ৪৫০-৫০০ টাকা হয়েছে।

২৫ টাকার লাউ ৩০-৪০ টাকা- ৫০ টাকা কেজি ধনিয়া পাতা ৭০-৮০; ২৫ টাকা হালি কলা ৩০; ২০ টাকার মিষ্টিকুমড়া ৩০-৩৫; ২০ টাকার শিম ২৫-৩০ ও ২৫ টাকার ফুলকপি ৩০-৪০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। শাকের আঁটি ১৫-২০ টাকা। পটোল, ঢেঁড়স ও মটরশুঁটির দাম বেড়েছে ৫ থেকে ১৫ টাকা।

সবজি বিক্রেতা ওসমান আলী বলেন, কোনো কিছুরই দাম কমছে না, বরং বাড়ছে। আমদানির ওপর নির্ভর করে বাজার ওঠানামা করছে। বাজার ঘুরে আদা, পেঁয়াজ ও রসুন কিনছিলেন মুন্সিপাড়া এলাকার সালমা বেগম নামে এক গৃহিণী। তিনি বলেন, ‘যে ব্যাগে সদাইপাতি নিয়ে যাব, সেটারও দাম বেড়েছে। রমজানে যা প্রয়োজনীয় তা কিনতেও এখন ভাবতে হচ্ছে। না কিনেও উপায় নেই।’

এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৮৭ টাকা, দুই লিটার ৩৭৪ ও খোলা ১৬০-১৯০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। প্যাকেট আটা ৬৫-৬৮ ও খোলা আটা ৫৮ থেকে ৬০ টাকা; ছোলা ৯০-১০০ ও প্যাকেট ময়দা ৭৮-৮০ টাকা কেজি। এ ছাড়া লবণ ৪০, মোটা মসুর ডাল ১০০, চিকন মসুর ১৩০, বুট ১০০, খেসারি ৮৫ ও মুগ ডাল ১৪০ টাকা কেজি পাওয়া যাচ্ছে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক আজহারুল ইসলাম বলেন, সবাই সমন্বিতভাবে কাজ করলে বাজারে সংকট হবে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক আছে। কারসাজি করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সংকট এড়াতে ভোক্তাদের একসঙ্গে এক সপ্তাহের বেশি বাজার না করার অনুরোধ জানান তিনি।