- সারাদেশ
- হাসিমুখে মা বললেন, ‘যা, দেশ স্বাধীন কর’
কিশোরগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধার মায়েদের বিরল সম্মাননা
হাসিমুখে মা বললেন, ‘যা, দেশ স্বাধীন কর’

মা মোবাশ্বেরা বেগমকে পাশে রেখে মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর ত্যাগের বর্ণনা দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান
সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধে পাঠানোর পেছনে মায়েদের ত্যাগ আর দেশপ্রেমের গল্প খুব একটা সামনে আসে না। মায়ের কাছে সন্তানের চেয়ে আবেগের ধন আর হয় না। এই আবেগকে ছাপিয়ে দেশপ্রেম যে কত উচ্চতায় একজন মাকে নিয়ে যেতে পারে, তার প্রমাণ নিজের হাতের বালা খুলে নাড়ি ছেঁড়া ধন ছেলের হাতে তুলে দিয়ে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠানোর বিরল নজির।
ছেলে আর নাও ফিরতে পারেন। প্রাণ যেতে পারে– এ কথা জেনেও দেশমাতৃকার জন্য সন্তানকে উৎসর্গ করা এমনই এক মাকে গতকাল বৃহস্পতিবার একটি ব্যাংকের উদ্যোগে বিরল সম্মাননা জানানো হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ছেলেকে পাশে রেখে ব্যাংকের পক্ষ থেকে মায়ের গায়ে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে জাতীয় সংগীত লেখা একটি স্মারক শাড়ি। পরিয়ে দেওয়া হয়েছে উত্তরীয়। হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ফুলের তোড়া। এর পর মুক্তিযোদ্ধা ছেলে বর্ণনা দিলেন মায়ের সেদিনের বিরল ত্যাগের কাহিনি। ৯৫ বছরের বৃদ্ধা মা ছলছল চোখে তাকিয়ে শুনছিলেন ছেলের আবেগঝরা বর্ণনা।
তিনি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের পিরিজপুর ইউনিয়নের জোয়ারিয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আব্দুল মান্নানের মা মোবাশ্বেরা বেগম।
কিশোরগঞ্জ শহরের এনআরবিসি ব্যাংকের এরিয়া শাখায় গতকাল মুক্তিযুদ্ধে ত্যাগ শিকার করা এই মাকে বিরল সম্মাননা জানানো হয়েছে। তাঁর নামে ব্যাংকের একটি কাউন্টারের নামকরণ করা হয়েছে। ব্যাংকের এরিয়াপ্রধান রকিবুল হাসানের সভাপতিত্বে ব্যাংক কার্যালয়ে সম্মাননা অনুষ্ঠানে আব্দুল মান্নান আবেগজড়িত কণ্ঠে স্মৃতিচারণ করছিলেন, ‘আমার বাবা আব্দুল বারিক একজন কৃষিজীবী ছিলেন। এখন তিনি জীবিত নেই। একাত্তরে আমার বয়স ২০ বছর। তখন নরসিংদী কলেজে বাণিজ্য শাখায় স্নাতক শেষ বর্ষে পড়ি। সাত ভাই ও তিন বোনের মধ্যে আমি সবার বড়।
একদিন মাকে জানালাম, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। আমি কী করে যুদ্ধে না গিয়ে বাড়িতে থাকি। আমি দেশের জন্য যুদ্ধে যাব। মা হাসিমুখে রাজি হলেন। বললেন যা, দেশ স্বাধীন কর। হাতের দুটি রুপার বালা খুলে আমার হাতে তুলে দিলেন ভারতে পৌঁছানোর খরচের জন্য। এটিই আমার সঙ্গে মায়ের জীবনের শেষ দেখা হতে পারে– এ কথা জেনেও মা হাসিমুখে আমাকে দেশের জন্য যুদ্ধে পাঠিয়ে ছিলেন।’
আব্দুল মান্নান জানান, তিনি ত্রিপুরা রাজ্যের লেবুচূড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নেন। ২১ দিন প্রশিক্ষণ নিয়ে সেকশন কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি কয়েকটি রেলসেতু ও পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে হামলায় অংশ নিয়ে সফল হন।
এনআরবিসি ব্যাংক কিশোরগঞ্জ এরিয়া অফিসপ্রধান রকিবুল হাসান জানান, গতকাল বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নানের মা মোবাশ্বেরা বেগমকে দিয়ে কিশোরগঞ্জ এরিয়া কার্যালয়ের দিনের কাজের সূচনা করা হয়। কিশোরগঞ্জ এরিয়ার ২৬টি শাখা, উপশাখা ও কালেকশন বুথের কার্যক্রম একই আনুষ্ঠানিকতায় শুরু করা হয়। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের মায়েদের খুব কম জনই এখন জীবিত আছেন। যেমন, এরিয়া অফিসের জন্য একজন মাকেই পাওয়া গেছে। যেখানে মায়েদের পাওয়া যায়নি, সেখানে মায়েদের পক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে দিনের কার্যক্রমের শুভসূচনা করা হয়েছে। আর সেসব শাখায় মুক্তিযোদ্ধাদের মায়েদের নামে একটি করে কাউন্টারের নামকরণ করা হয়েছে।
রকিবুল হাসান জানান, সবাই কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা জানান। কিন্তু তাঁদের মায়েদের যে ত্যাগ, সেটা খুব একটা সামনে আসে না। সেই কারণে তাঁদের ব্যাংকের পক্ষ থেকে মায়েদের সম্মাননা জানানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
রকিবুল হাসান আরও জানান, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারের যে ১৫ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়ছে, তাঁদের স্মরণেও অবহেলিত মানুষদের মাঝে উপঢৌকন দেওয়া হয়েছে। যেমন, শেখ রাসেল লাল রঙের সাইকেল চালাতেন। সেই কারণে অবহেলিত এক শিশুকে লাল রঙের সাইকেল দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য করুন