- সারাদেশ
- কৃষিতে ব্যয় বৃদ্ধির ধাক্কায় কষ্টে কৃষক
কৃষিতে ব্যয় বৃদ্ধির ধাক্কায় কষ্টে কৃষক

এক সময় পরিবারের সব জমিজমা একাই চাষ করতেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর ধোরলা গ্রামের বাসিন্দা আবু ছিদ্দিক। কিন্তু এখন চাষাবাদে তাঁর এই আগ্রহে ভাটা পড়েছে। ধান চাষে খুব একটা লাভ না হওয়ায় আগে যে পরিমাণ জমিতে চাষ করতেন, এখন তা আর করছেন না। কিছু জমি বর্গা দিয়েছেন। কিন্তু বর্গাচাষির কাছ থেকেও আশানুরূপ ধান কিংবা টাকা পাচ্ছেন না। তবুও জমি পতিত না রাখতে এভাবে চাষ করছেন তিনি। একই এলাকার বাসিন্দা মো. ওসমানের নিজের জমি নেই। কয়েক বিঘা জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেন তিনি। এভাবে বছরের একটি অংশ পরিবারের সদস্যদের অন্নের ব্যবস্থা হয়। তবে এবার চাষাবাদে খরচ বেড়ে যাওয়ায় চোখে অন্ধকার দেখছেন তাঁরা। শুধু আবু ছিদ্দিক বা মো. ওসমানই নন, চাষাবাদে অস্বাভাবিক খরচ বেড়ে যাওয়ার ধাক্কায় কষ্টে আছেন কৃষক।
কৃষি বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন পর্যায়ের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত মৌসুমে এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে বোরো চাষে সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ হয়েছিল কমবেশি ১৩ হাজার টাকা। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে খরচ বেড়েছে ৪ হাজার টাকার বেশি। মূলত জ্বালানি তেল ডিজেল, বিদ্যুৎ, সার, কীটনাশক, বীজ এবং শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় চলতি মৌসুমে বোরো চাষে খরচ অনেকাংশে বেড়ে গেছে। লাগাম ছাড়া খরচের প্রভাব পড়ছে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বোরোর চাষাবাদেও।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী– এই পাঁচ জেলা নিয়ে চট্টগ্রাম কৃষি অঞ্চল গঠিত। এর মধ্যে নোয়াখালীতে সবচেয়ে বেশি ও ফেনী জেলায় সবচেয়ে কম জমিতে বোরোর আবাদ করা হয়। কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বোরো মৌসুমে এই অঞ্চলে চাষাবাদ করার মতো প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমি রয়েছে। এর মধ্যে ২ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করা হয়েছে। গত মৌসুমে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল ২ লাখ ৬৭ হাজার ৯০৫ হেক্টরে। এ হিসাবে প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ বাড়লেও প্রায় ২২ হাজার হেক্টর জমি পতিত থেকে যেতে পারে। চাষাবাদে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় অনেক কৃষকই ধান চাষে আগ্রহী হচ্ছেন না। এই অবস্থায় চাষাবাদে ব্যয় বৃদ্ধির ধাক্কা সামাল দিতে উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ধানের চাষাবাদে পরামর্শ দিয়ে দায় সারছে সংশ্লিষ্ট কৃষি অধিদপ্তর।
কৃষকরা জানিয়েছেন, গত মৌসুমে ডিজেল বাবদ বিঘাপ্রতি সেচে কৃষককে ব্যয় করতে হয়েছে ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা। বিঘাপ্রতি ২৩ থেকে ২৫ লিটার ডিজেলের প্রয়োজন হয়। তবে ডিজেলের দাম বাড়ায় চলতি বোরো মৌসুমে বিঘাপ্রতি প্রত্যেক কৃষককে ব্যয় করতে হচ্ছে সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা।
ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সেচ ব্যয় বেড়ে যাওয়া ছাড়াও অন্যান্য খাতেও বেড়েছে চাষাবাদ ব্যয়। যেমন প্রতি কেজি বীজ ছিল ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, এবার তা হয়েছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। এ ছাড়া সার খরচ ২ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার টাকার ওপরে। আবার কীটনাশকের দামও বেড়েছে। এখাতে প্রতি বিঘায় খরচ ৫০০ থেকে বেড়ে ৮০০ টাকা হয়েছে। এর বাইরে ধান রোপণসহ চাষাবাদের শ্রমিকদের দৈনিক মুজরিও এখন হাজার টাকা। এ ছাড়া আরও অন্যান্য খরচ তো রয়েছেই।
গত মৌসুমে প্রতি মণ বোরো ধান বিক্রি হয়েছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা। কিন্তু ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় চলতি মৌসুমে প্রতি মণ ধান বিক্রি করতে হবে ১ হাজার ১৫০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায়। এর কম দামে ধান বিক্রি করতে হলে লাভ তো হবেই না, উল্টো লোকসান গুনতে হবে কৃষকদের।
চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ড. অরবিন্দ কুমার রায় বলেন, এমনিতেই যাতে জমি পতিত পড়ে না থাকে সেজন্য আমরা চেষ্টা চালাই। এবার এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনা থাকায় তাতে জোর দেওয়া হচ্ছে। তবে চাষাবাদে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কৃষকদের যাতে ক্ষতির মুখে পড়তে না হয়, সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সার, বীজ ও সেচের ক্ষেত্রে দেওয়া হচ্ছে প্রণোদনা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক আবদুচ ছোবহান বলেন, ব্যয় বাড়লেও বোরো চাষে ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকদেরও আগ্রহ থাকে বেশি। বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় না ঘটলে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে না।
মন্তব্য করুন