দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট লইয়া সমকালে বুধবার হইতে শুক্রবার পর্যন্ত প্রকাশিত তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে যে চিত্র তুলিয়া ধরা হইয়াছে, উহা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। প্রতিবেদন অনুসারে, উক্ত এলাকাসমূহে একদিকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর মারাত্মকভাবে নামিয়া গিয়াছে; অন্যদিকে লবণাক্ততার কারণে সম্পূর্ণ বাস্তুসংস্থানের পরিবর্তন ঘটিতেছে। উদাহরণস্বরূপ, বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের অতি সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গিয়াছে, পানীয় জলের অভাব তীব্র আকার ধারণ করার ফলে বর্তমানে মোংলার ৮০ শতাংশ এবং শ্যামনগরের ৭০ শতাংশ পরিবার রহিয়াছে স্থানান্তরের শঙ্কায়।

শুধু উহাই নহে, যেহেতু নারীদেরই মূলত পানি সংগ্রহের কাজটি করিতে হয়; উক্ত পানি সংকটের নেতিবাচক প্রভাব তাহাদের উপরেই পড়িতেছে বেশি। যেমন মোংলায় ৬৪ শতাংশ এবং শ্যামনগরে ৫৪ শতাংশ নারী প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগিতেছেন। তাঁহাদের অনেকে ইতোমধ্যে জরায়ু, গর্ভাশয় ও গর্ভনালির ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ অপসারণে বাধ্য হইয়াছেন। এমনকি বহুবিধ সামাজিক সমস্যাও মোকাবিলা করিতে হইতেছে উক্ত এলাকাসমূহের মানুষকে।

উপর্যুক্ত গবেষণায় জানা গিয়াছে, একই উৎস হইতে পানি সংগ্রহ করিতে গিয়া মোংলায় প্রায় ৫৮ শতাংশ এবং শ্যামনগরে ৭৬ শতাংশ নারী প্রতিবেশীর দুর্ব্যবহারের শিকার হইয়াছেন। অধিকন্তু উভয় এলাকায় যৌন হয়রানির শিকার হইয়াছেন ১০ শতাংশ এবং শারীরিক হামলার শিকার ৭০ শতাংশ। দুঃখজনক, সমস্যাটি বহু প্রাচীন এবং ইহা লইয়া অদ্যাবধি বিস্তর গবেষণা হইলেও সরকারেরর দিক হইতে অন্তত উহার তীব্রতা হ্রাসে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয় নাই। যে কারণে দেশে মৌলিক পানির সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষের হার ৯৮ শতাংশ হইলেও সাতক্ষীরায় উহা মাত্র ৬২ শতাংশ। এই পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করিয়া কোনো কোনো ব্যক্তি ও বেসরকারি সংস্থা সংকটগ্রস্ত মানুষের পকেট কাটিবার আয়োজন করিয়াছে। যেমন প্রতিবেদনমতে, খুলনার পাইকগাছায় মানুষকে এক সহস্র লিটার সুপেয় পানি ক্রয় করিতে হয় ৬০ হইতে ১৫০ টাকায়, যদিও ঢাকা ওয়াসায় উহা ১৫ টাকায় পাওয়া যায়।

অনস্বীকার্য, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের এহেন দুর্ভোগের প্রধান কারণ সামগ্রিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব এবং প্রতিবেশী ভারত কর্তৃক আন্তঃসীমান্ত নদী গঙ্গার উজানে একতরফা পানি প্রত্যাহার হেতু স্বাদু পানির উৎসসমূহে সমুদ্রের নোনাপানির অনুপ্রবেশ। তবে ইহাও স্বীকার করিতে হইবে, এই সমস্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব হ্রাসকরণ প্রযুক্তি বিশ্বে এখন বিরল নয়। এ প্রসঙ্গে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, নির্লবণীকরণের মাধ্যমে সমুদ্রের পানি ব্যবহার এবং রিভার্স অসমোসিস পদ্ধতিতে সকল ধরনের খনিজ লবণ হইতে সুপেয় পানিকে মুক্ত করার কথা বলা যাইতে পারে।

বলা বাহুল্য, ইতোমধ্যে এই সকল পদ্ধতির কোনো কোনোটা দেশে ব্যবহৃতও হইতেছে; যদিও সীমিত পরিসরে। যেমন ২০০৯ সাল হইতে বেসরকারি সংস্থা ‘প্রবাহ’ দেশের ২২ জেলায় ১১৭টি পানি পরিশোধন প্ল্যান্ট স্থাপনের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ ৮৩ হাজার মানুষকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করিতেছে। কিন্তু প্রতিবেদনেই বলা হইয়াছে, যখনই এই সকল প্রযুক্তি ব্যবহার করিয়া খুলনা বা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বৃহৎ পরিসরে সুপেয় পানি সরবরাহের প্রসঙ্গ উঠিয়াছে, তখনই সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর হইতে বাজেট ঘাটতির কথা বলা হইয়াছে। এই দিক হইতে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের সুপেয় পানির চলমান সংকটকে যদি সামগ্রিকভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের প্রতি রাষ্ট্রীয় উন্নয়নবঞ্চনার ফল বলা হয়, তাহা কি অত্যুক্তি হইবে?

আমরা মনে করি, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষকে বঞ্চিত করিয়া কোনো টেকসই উন্নয়ন সম্ভবপর নহে। মূলত এহেন ভ্রান্ত উন্নয়ন নীতির অনিবার্য পরিণতিতেই রাজধানীসহ বৃহৎ শহরগুলি এক প্রকার প্রসারমান বস্তি আখ্যা পাইতেছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহেও সকলের জন্য নিরাপদ সুপেয় পানি নিশ্চিতকরণের কথা বর্ণিত। তাই সরকার সমস্যা সমাধানে দ্রুত নজর দিবে বলিয়া আমাদের প্রত্যাশা।