- সারাদেশ
- কালের সাক্ষী মন্দির
কালের সাক্ষী মন্দির

রাধা গোবিন্দমন্দির / ইনসেটে নকুলেশ্বর শিবমন্দির
চলনবিলের প্রাণকেন্দ্র সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ প্রাচীন ঐতিহ্যের এক লীলাভূমি। এখানে কয়েক শতাব্দী ধরে কালের সাক্ষী হয়ে বহু মূল্যবান প্রত্নসম্পদ মন্দির দাঁড়িয়ে আছে। অনেকে এ সম্পর্কে অবগতও নন। যথাযথ সংস্কারের অভাবে জীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। লিখেছেন এম আতিকুল ইসলাম বুলবুল
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের ৭ পৌষে শান্তিনিকেতনে লিখেছিলেন– ‘বহু দিন ধরে’ বহু ক্রোশ দূরে / বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে / দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,/ দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।/ দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশির বিন্দু।’
সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ যেন সেই ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যমণ্ডিত জনপদ, যা অনেকেরই অদেখা-অজানা। এক সময়ের হিন্দুপ্রধান এ অঞ্চলে রানী ভবানী, প্রণবানন্দ রায়, বনওয়ারী লাল রায় বাহাদুরসহ বিভিন্ন সময়ে জমিদাররা মন্দির নির্মাণ করেন। এসব মন্দিরে আজও স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পূজা-অর্চনা করছেন। কথিত আছে, এখানকার মন্দিরগুলোর কারণে এক সময় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে তাড়াশ ‘গুপ্ত বৃন্দাবন’ নামে খ্যাত ছিল।
রাধা গোবিন্দ মন্দির
মন্দিরের শহরখ্যাত তাড়াশের রাধা গোবিন্দমন্দিরটি ১১০৫ বঙ্গাব্দে তৎকালীন জমিদার রাজা বনওয়ারী লাল রায় বাহাদুর নির্মাণ করেন। তাড়াশ বাজারের মধ্যে দৃষ্টিনন্দন ৯টি স্তম্ভের দর্শনীয় নকশা আঁকা চূড়াবিশিষ্টি এ মন্দির। মূল মন্দিরের ভেতরে বড় পরিসরের তিনটি কক্ষ রয়েছে। আরও আছে প্রশস্ত একটি বারান্দা।
বারান্দায় রয়েছে বড় আকারের একটি পিতলের মঙ্গল ঘণ্টা। মন্দিরের সামনে সমান চার কোনাবিশিষ্ট বাংলা ইট দিয়ে তৈরি বড় বড় পিলারের একটি আট চালা ছাদ। এ ছাদ বড় বড় লোহার খণ্ড, ইট-সুরকি, চুন দিয়ে পুরু করে তৈরি করা। মন্দিরটির দেয়ালে সাপ, ফুলসহ নানা চিত্র, কারুকার্য খচিত। ২ একর ৬ শতক জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটি বর্ণিল কারুকার্যে গড়া প্রত্নসম্পদ।
বর্তমানে মন্দির পরিচালনা পর্ষদের উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে এটির মূল নকশার কোনো পরিবর্তন না করে সংস্কার করে পর্যটকদের প্রবেশের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সে জন্য তাড়াশের অন্যান্য মন্দিরের চেয়ে এটি পরিচ্ছন্ন। সম্মুখভাগে বেশ প্রস্থ আঙিনাটি দৃষ্টিনন্দন। চাপা ফুলের গাছটি আঙিনার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। কারুকার্যময় মন্দিরটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম গোবিন্দমন্দির।
কপিলেশ্বর শিবমন্দির
১০৫০ বঙ্গাব্দে নাটোরের জমিদার রানী ভবানীর আমলে কপিলেশ্বর মন্দিরটি নির্মিত হয়। এটি মুক্তিযোদ্ধা মোড় এলাকায় অবস্থিত। মন্দিরটি তেমন বড় নয়। ছোট আকারের লাল ইট দিয়ে নির্মিত দেয়ালের চারপাশ পোড়া মাটির টেরাকোটা দিয়ে মোড়ানো। সেই টেরাকোটা দেব-দেবী, ঘোড়া, ফুলসহ নানা আল্পনায় আচ্ছাদিত।
মন্দিরের ভেতরে ঢোকার দরজার দেয়ালেও টেরাকোটা শোভা পাচ্ছে। এখানে একই আকৃতির দুটি মন্দিরের ভেতরের মেঝের প্রায় মধ্যখানে মাঝারি আকারের কালো পাথরের দুটি শিবলিঙ্গ রয়েছে। মন্দির চত্বরে প্রবেশপথ সংকীর্ণ। চত্বরের আঙিনাটিও বেশ ছোট। মন্দিরটির চারপাশে দোকান, বাসা-বাড়ি ও নানা স্থাপনার কারণে দূর থেকে মন্দিরের অস্তিত্বই টের পাওয়া যায় না।
মন্দিরটির দেয়ালে শ্যাওলা এবং বট পাকুড় বাসা বাঁধায় এর মূল সৌন্দর্য কমেছে। তবে একটা আদিম সৌন্দর্যও রয়েছে এতে। কথিত আছে, নাটোরের জমিদার রানী ভবানীর বিশ্বস্ত নায়েব তারা শংকর রায় নৌকায় নাটোর থেকে হাটিকুমরুলের নবরত্ন মন্দিরে যাচ্ছিলেন। যাত্রাপথে লক্ষ্য করেন, জলমগ্ন ও তারুটের কাঁটায় ভরপুর বর্তমান তাড়াশ সদরে কপিলেশ্বর শিবমন্দিরের স্থানে একটি কালো গাভি দাঁড়িয়ে আছে।
তিনি গরুর পিছু পিছু এসে দেখতে পান, গরুটি বর্তমান মন্দিরটির স্থানে এসে দাঁড়িয়ে যায়। এ সময় ওই গরুর স্তন থেকে আপনাআপনি দুধ বের হতে থাকে এবং ওই স্থানটি দুধে ভেসে যাচ্ছে। এমন অলৌকিক দৃশ্য দেখে তিনি ওই স্থানকে পবিত্র মনে করেন। এরপর রাতে স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে নায়েব তারা শংকর রায় রানী ভবানীর অনুমতিক্রমে সেখানে কপিলেশ্বর শিবমন্দির নির্মাণ করেন। এটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে তীর্থস্থানের মতো। প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো এ মন্দির ১৭ শতাংশ জায়গার ওপর নির্মিত; পাশাপাশি দুটি মন্দিরে বিভক্ত। এ মন্দিরে টেরাকোটায় বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি অঙ্কিত আছে। পুরোনো মন্দিরটি দর্শনার্থীদের জন্য সব সময় খুলে রাখা হয়। তবে সংস্কারের অভাবে অনেক মূল্যবান টেরাকোটা চুরি হয়ে গেছে বলে জানা যায়।
ত্রিদল মঞ্চমন্দির
তাড়াশ সদর বাজারের মধ্যস্থলে উপজেলা সহকারী কমিশনারের কার্যালয়ের পাশে ঐতিহ্যবাহী ত্রিদল মঞ্চমন্দিরটি অবস্থিত। এটি প্রায় আড়াইশ বছরের পুরোনো। এটি নির্মাণের সঠিক সন-তারিখ জানা যায় না। তবে জমিদার আমলের শেষ দিকে কোনো একজন জমিদার নির্মাণ করেছেন বলে অনুমান করা হয়। তিনটি স্তরে নির্মিত এ মন্দিরে ছোট আকারের ইট-সুরকি, চুনসহ তৎকালীন আমলের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে।
চতুর্ভুজ আকৃতির মন্দিরের ভেতরে আছে ছোট ছোট ১২টি কুঠরি। আবার মন্দিরের ওপরে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরে ওঠার জন্য রয়েছে সরু আকারের সিঁড়ি। মন্দিরের দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরও চতুর্ভুজ আকৃতির। ওপরের অংশে রয়েছে একটি চূড়া। তবে এখানে কোনো দেব-দেবীর মূর্তি এখন আর নেই। এখানেও নানা স্থাপনার কারণে মন্দিরের ভবনটি ছাড়া কোনো জায়গা অবশিষ্ট নেই। মন্দিরটি দৃষ্টির আড়ালেই চলে গেছে। সেসব স্থাপনা মাড়িয়ে তবেই এখানে প্রবেশ করা সম্ভব। জনশ্রুতি আছে, জমিদার আমলে পশ্চিমবঙ্গ থেকেও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ত্রিদল মঞ্চমন্দিরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন।
নকুলেশ্বর শিবমন্দির
তাড়াশ সদরে সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে অবস্থিত নকুলেশ্বর মন্দির। সেখানে ১৩ শতক জায়গা রয়েছে মন্দিরের। ঐতিহ্যবাহী এ মন্দিরটি প্রায় আড়াইশ বছরের পুরোনো বলে ধারণা করা হয়। অনেকটা গোলাকার আকৃতির এ মন্দিরের ভেতরে একটি মাঝারি আকারের কালো পাথরের শিবলিঙ্গ রয়েছে। সাদা রঙের পুরু চুনকাম করা মন্দিরের দেয়ালে ও ভেতরে রয়েছে পরী, ঘোড়ার শরীরে মানুষের মুখ, ফুলের আল্পনা, মন্দিরের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে জোড়া হাতির মূর্তি; যা তখনকার সময়ে খাঁচ কেটে দর্শনীয় কারুকার্যের মাধ্যমে করা হয়েছে।
এ মন্দিরের নির্মাণশৈলীটিও অনেকটা ব্যতিক্রমী। কেননা মন্দিরের নিচ থেকে তৈরি করতে করতে ওপর অংশে গিয়ে গম্বুজ আকৃতি করা হয়েছে; যা সচরাচর পুরাকীর্তিতে দেখা যায় না। আবার গম্বুজটির নির্মাণশৈলীতেও নানা শিল্পকর্ম চোখে পড়ার মতো। এখানে প্রবেশের পথও খুবই সরু। আশপাশে স্থাপন করা দোকানের কারণে মূল মন্দিরটির তিন পাশ দেখাই যায় না। পাশাপাশি ভেতরের আঙিনাটিও ছোট্ট হওয়ায় একবারে ৫ থেকে ১০ জনের বেশি ঢোকাও সম্ভব নয়।
এসব ঐতিহাসিক স্থাপনা যে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে, তাতেও সন্দেহ নেই। তবে সময়ের পরিক্রমায় মহামূল্যবান এই প্রত্নসম্পদ বহু বছর ধরে সংস্কারের অভাবে এখন ধ্বংস হতে বসেছে। স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন দপ্তরে অনেক আবেদন-নিবেদন করেও মন্দিরগুলো সংস্কার করার কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করা হয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এসব প্রত্নসম্পদ কার্যত ঐতিহাসিকভাবে অমূল্য। তা সংস্কার এবং দর্শনার্থীদের কাছে মনোমুগ্ধ করতে এখনই কার্যকর ভূমিকা নেওয়া দরকার বলে প্রত্যাশা এলাকাবাসীর।
তাড়াশ উপজেলা সনাতন সংস্থার সভাপতি সঞ্জিত কর্মকার ও সাধারণ সম্পাদক সনাতন দাশ জানান, স্থানীয়রা কোনোভাবেই প্রত্নসম্পদ মন্দিরগুলোর ধ্বংস দেখতে চান না। তাই মন্দিরগুলো রক্ষায় সংশ্লিষ্ট বিভাগের সুদৃষ্টি কামনা করছেন। এ প্রসঙ্গে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মোছা. নাহিদ সুলতানা বলেন, ‘এর আগে তাড়াশের মন্দিরগুলো সংস্কারের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কিন্তু নানা কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। তবে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে তাড়াশের প্রত্নসম্পদ মন্দিরগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
মন্তব্য করুন