- সারাদেশ
- শরণার্থী শিবিরের জীবন ও মৃত্যু
শরণার্থী শিবিরের জীবন ও মৃত্যু

তরুণ বাংলাদেশি বিশেষ করে ১৯৭১ সালের পর যাদের জন্ম, তাদের সঙ্গে কথা বলে আমি প্রায়ই দেখতে পাই, তাদের বাবা-মা এবং দাদা-দাদিরা মুক্তিযুদ্ধের সময় যে কষ্ট ও বেদনার মধ্য দিয়ে গেছেন এবং যেভাবে লাখ লাখ বাংলাদেশি জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে গেছেন, সে সম্পর্কে তারা সত্যিই জানে না বা অনুধাবনের চেষ্টা করে না। অথচ প্রত্যেকের সঠিক ইতিহাস বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালে আমি ভারতে অক্সফ্যামের সঙ্গে কাজ করছিলাম এবং বিষয়টি বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছি; কারণ আমিও সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি এবং প্রায়ই সে দুঃস্বপ্ন অনুভব করি। আমার মনে এখনও দাগ কেটে আছে, বৃষ্টিতে আমি ভারতীয় কর্দমাক্ত এক শরণার্থী শিবিরে দাঁড়িয়ে আছি আর আমার কোলে বাংলাদেশি এক মৃত শিশু! স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশিরা ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস গভীর শোক ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।
একাত্তরের ২৫-২৬ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন ঢাকা দখল করে, তখন শহরের অর্ধেকেরও বেশিসংখ্যক মানুষ জীবন রক্ষায় পালিয়ে যায় এবং দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে শরণার্থীর স্রোত দ্রুতই ঢেউ হয়ে ভারতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। এপ্রিলের শেষ নাগাদ ছয় লাখ মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে এবং মে মাসের শেষে দাঁড়ায় ১৫ লাখ। জুন মাসে আরও ৩৫ লাখ যুক্ত হয়। এভাবে বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষের ঢল অব্যাহত ছিল। জুলাই শেষে তা দাঁড়ায় ৭০ লাখে; আগস্টে ৮০ লাখ। অবশেষে নভেম্বরের শেষে প্রায় এক কোটিতে পৌঁছে। শরণার্থীদের আসার দৃশ্য ছিল হৃদয়বিদারক।
একজন প্রতিবেদক লিখেছেন, ‘সবচেয়ে দুর্বলরা পাকিস্তানে রয়ে গেছে; দুর্বলরা পথে মারা গেছে আর এখন সবলরা বেঁচে আছে।’ অন্য এক প্রত্যক্ষদর্শীর জুন মাসের বিবরণ ছিল এ রকম: ‘আমি ছোট্ট পরিবারের একটি দল দেখতে পাই। সামনে থাকা এক যুবক বাবার কোমরে পাতলা ও বাদামি ভেজা মাটির দাগযুক্ত কাপড়; তার মাথায় বাঁধা কাঠের টুকরো এবং রান্নার দুটি হাঁড়ি। বাবার কাপড় আঁকড়ে ধরেছিল প্রায় ৪ বছরের ছোট ছেলে। সে শুধু একটি ছেঁড়া ও নোংরা শার্ট পরে ছিল এবং তার ছোট পা ফুলে গিয়েছিল। শিশুটির ঠিক পেছনে চলছিলেন মা। মায়ের সঙ্গে ছিল দুটি শিশু। একটিকে নিয়েছেন তাঁর বাহুতে, অন্যটি ছিল কাঁখে। বাবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হোঁচট খাচ্ছিলেন মা। তাঁর শাড়ির কোণে বাঁধা ছিল কেরোসিনের বাতির হাতল। হাঁটতে গিয়ে সেটি তাঁর পায়ে ঠেকছিল। বাবা বললেন, তাঁরা সাত দিন ধরে হাঁটছেন; কিন্তু সব ক্যাম্প পূর্ণ হয়ে গেছে...।’
চিকিৎসার চ্যালেঞ্জ
সর্ব সেবা সংঘ ও গান্ধী পিস ফাউন্ডেশনের মতো গান্ধীবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে অক্সফ্যামের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সে কারণে অক্সফ্যাম সহায়তা করতে পারে, এমন একটি কর্মসূচির জন্য আমরা তাদের সঙ্গে আলাপ–পরামর্শ করি। যখন জাতিসংঘ ও অন্যান্য সাহায্যকারী সংস্থা প্রবাসী তথা শরণার্থী শিবিরে বাংলাদেশিদের সেবা দিতে উড়ে যাচ্ছিল, তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম–আমাদের পরিচিত ভারতীয় সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করব। এটা পরে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল। কারণ ভারত সরকার তখন নিরাপত্তার জন্য সীমান্ত এলাকায় বিদেশিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিল।
শুরুতে কলকাতা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক, শিক্ষানবিশ চিকিৎসক এবং মেডিকেল শিক্ষার্থীরা শরণার্থী শিবিরে পালাক্রমে কাজ করতেন। অক্সফ্যামের সহায়তায় কলেজ কর্তৃপক্ষ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছ থেকে এ অনুমোদন নিতে সক্ষম হয়েছিল–শরণার্থী শিবিরের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের এমবিবিএস ডিগ্রিতে ব্যবহারিক সামাজিক ও প্রতিরোধমূলক চিকিৎসার অংশ হিসেবে গণ্য করা হবে। এই খবরটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় অক্সফ্যামের শরণার্থী ত্রাণ সমন্বয়কারী হিসেবে আমি বোম্বে মেডিকেল কলেজের পাশাপাশি উড়িষ্যা, গুজরাট ও পাঞ্জাব থেকে এক মাসের জন্য আগত মেডিকেল টিমের দায়িত্ব নিয়েছিলাম।
তখন ভারতীয় এই তরুণেরা যে কাজটি হাতে নিয়েছিলেন, তা ছিল অত্যন্ত কঠিন ও শ্রমসাধ্য। ভারী বর্ষার কারণে সৃষ্ট বন্যায় অনেক শরণার্থী শিবির ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়। সে সময় আমি যেসব লজিস্টিকস বা রসদের দায়িত্বে ছিলাম, সেগুলোর ব্যবস্থা করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। একসময় কলকাতা কর্তৃপক্ষ যখন শহরজুড়ে কলেরা ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কায় ছিল, তখন পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্যসেবার মহাপরিচালক ডা. সাহা আমাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন– নিরপেক্ষ এলাকা তথা বাফার জোন বা কলকাতা ও এর আশপাশে টিকা দেওয়ার জন্য কলেরার টিকা বহনের একটি উড়োজাহাজের ব্যবস্থা করতে পারি কিনা। অক্সফ্যাম তখন ১০ লাখের বেশি ডোজ টিকা কিনে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কলকাতায় পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিল। ডা. সাহা সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমি বিশ্বকে এবং বিশেষ করে ব্রিটেনকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বেচ্ছাসেবকরা টিকা প্রয়োগ করার সরঞ্জাম নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন। আমি তাঁদের পরামর্শ দিয়েছিলাম, ভয়ানক পরিস্থিতিতে তাঁদের কাজ করতে হবে এবং তাঁরা সরাসরি মাঠে নেমেছিলেন। তাঁরা যেভাবে কাজ করেছিলেন সেভাবে সবাইকে আমি যথেষ্ট ধন্যবাদও দিতে পারিনি।’
অক্সফ্যাম তখন যুক্তরাজ্য থেকে কলেরাবিরোধী বিশেষ সরঞ্জাম ‘পাঞ্জেট’ ও ‘পেডোজেট’-এর মাধ্যমে নতুন ইন্ট্রা-ডার্মাল জেট স্প্রেসহ উচ্চচাপে সীমান্ত ক্রসিংগুলোতে গণকলেরার টিকা দেওয়ারও ব্যবস্থা করেছিল। এই মেশিনগুলোর মাধ্যেম সুই ব্যবহার ছাড়াই ত্বকের মধ্যে টিকা প্রবেশ করানো যায় এবং একটি মেশিন প্রতি ঘণ্টায় এক হাজার মানুষকে টিকা দিতে পারে। আরেকটি সমস্যা ছিল, কলেরা রোগীদের চিকিৎসার জন্য শিরায় স্যালাইন দেওয়ার পর্যাপ্ত বোতল পাওয়া যায়নি। কলকাতায় নিরাপদে স্যালাইন উৎপাদন করা যেত, কিন্তু পর্যাপ্ত খালি বোতল ছিল না! সে জন্য যুক্তরাজ্য থেকে দুটি বিমানে স্যালাইনের বোতল বোঝাই করে আনার ব্যবস্থা করে অক্সফ্যাম। আমরা বোতলগুলোকে পুনঃব্যবহার এবং সেগুলো কলকাতায় রিফিলের ব্যবস্থা করি। মাঝেমধ্যে যখন স্যালাইন পাওয়া যেত না, তখন আমি ডাক্তারদের ডাবের পানি ব্যবহার করে পরীক্ষা করতে দেখেছি! আরও ভিন্ন ধরনের মহামারিও ক্যাম্পের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেটি ব্যাপক অস্বস্তি সৃষ্টি করে। সেই সময় ‘জয় বাংলা’ নামে পরিচিত কনজাংটিভাইটিস বা চোখের রোগও ব্যাপক আকার ধারণ করে। সে জন্য যুক্তরাজ্য থেকে ১০ লাখ টিউব চোখের মলমও আসে।
পানিশূন্যতায় খাবার স্যালাইন
একাত্তরে শরণার্থী শিবিরগুলোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থাকায় শরণার্থীরা স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিল। আমরা ১৯৭১ সালের কলেরা মহামারি সম্পর্কেই বেশিরভাগ শুনি। এটি একটি বড় হুমকি ছিল বটে, কিন্তু কলেরায় সেই অর্থে বেশি মানুষ মারা যায়নি। ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি বা খাবার স্যালাইন অনেক জায়গায় সফলভাবে মহামারি মোকাবেলা করেছে। খাবার স্যালাইনের প্রথম সাফল্য দেখা যায় পূর্ব পাকিস্তানের কলেরা গবেষণাগারে (বর্তমানে আইসিডিডিআর,বি), কিন্তু তখন পর্যন্ত এটি ব্যাপকভাবে উৎপাদন হয়নি। কিছু আমেরিকান ডাক্তার যাঁরা সেই সময়ে গবেষণাগারে কাজ করছিলেন, তাঁদের ১৯৭১ সালের এপ্রিলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত ফিরে আসেন এবং পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবিরে কর্মরত প্যারামেডিকদের (চিকিৎসায় সহায়তাদানকারী প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী) প্রশিক্ষণ দেন। তাঁদের শেখানো হয় কীভাবে স্যালাইন তৈরি করতে হয়। কিছু শরণার্থী শিবিরে কলেরায় আক্রান্তদের ৩০ শতাংশ মারা গিয়েছিল। কিন্তু খাবার স্যালাইন ব্যবহারের পর মৃত্যুর হার ৩ শতাংশে নেমে আসে। তবে আমাদের অন্যান্য রোগের কথাও মনে রাখতে হবে। সে বছর ব্যাপক বৃষ্টিপাতে শরণার্থী শিবির প্লাবিত হয়। যে কারণে টাইফয়েড, ম্যালেরিয়াসহ পেট ও অন্ত্রের বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। সেখানকার স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভালো ছিল না। কিছু শিবিরে বিভিন্ন দাতা সংস্থার কর্মীরা তাঁদের সামর্থ্য অনুযায়ী ল্যাট্রিন সংকট দূর করতে ব্যবস্থা নেন। কিন্তু এটা অত্যন্ত কঠিন ছিল।
সবচেয়ে নাজুক শ্রেণি শিশু ও বৃদ্ধ
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় দিবস উদযাপনের আগ পর্যন্ত ৯ মাসজুড়ে শরণার্থী যারা সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ে, তারা ছিল শিশু ও বৃদ্ধ। প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাব ও স্যানিটেশনের ভয়ানক পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল ৫ বছরের কম বয়সী শিশু এবং খুব বৃদ্ধ জনগোষ্ঠী। কিছু শরণার্থী শিবিরে এরাই ছিল জনসংখ্যার অর্ধেক। মৃত্যুর রেকর্ডগুলো একেবারে সঠিক না হলেও অনেকেই অনুমান করেছেন, শরণার্থী শিবিরে ১০ লাখ শিশু মারা গেছে। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে কিছু শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে লিখেছিলেন, ‘আপনি দেখেন, শিশুদের পা ফুলে গেছে। অপুষ্টিতে ভুগছে তারা। তাদের মায়েদের বাহুতে শক্তি নেই। আপনি দেখতে পাচ্ছেন, শিশুরা অপুষ্টিতে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে; তাদের মায়েদের বাহু অসাড়। আপনি দেখতে পাচ্ছেন, শিশুরা ভিটামিনের অভাবে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা ঘা দিয়ে ঢেকে যাচ্ছে পুরো শরীর, যা সেরে ওঠা কঠিন। আপনি তাদের পিতা-মাতার চোখে তাদের সন্তানরা আবার ভালো হবে কিনা, সে বিষয়ে হতাশা দেখতে পাচ্ছেন এবং সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার, আপনি একটি শিশুর মৃতদেহ দেখতে পাচ্ছেন, যে ঠিক আগের রাতে মারা গেছে।’
জুলিয়ান ফ্রান্সিস: বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়া ব্রিটিশ মানবাধিকারকর্মী ও মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত; ইংরেজি থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
মন্তব্য করুন