
রাজধানী ঢাকা শহরে আনুমানিক তিন কোটি লোকের বসবাস। কিন্তু ভূমিকম্পের আঘাতে যে কোনোদিন এই শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে। ঢাকার ভূ-অভ্যন্তরের কাঠামোই বলে দিচ্ছে, বড় একটা ধাক্কা অপেক্ষা করছে এই শহরের জন্য। ক’দিন আগে সিলেটে ৪ দশমিক ৩ মাত্রার একটি মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়। যার উৎপত্তিস্থল মেঘালয়ে; ঢাকা থেকে ২০৩ কিলোমিটার দূরে। বাংলাদেশে যদি এর থেকে বেশি মাত্রার একটা ভূমিকম্প হয়, তাহলে এই ধাক্কাটা কেমন হবে, একটু ব্যাখ্যা করা যাক।
ঢাকার ভৌগোলিক অবস্থানটা হচ্ছে ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মার গতিশীল তিনটি প্লেটের কাছাকাছি, যার দুই দিকের ভূ-গঠনে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়ে আছে। এর একটি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল হিসেবে পরিচিত সিলেট এলাকায়, যাকে ডাউকি ফল্ট বলা হয়। আরেকটি ফল্ট রয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের ত্রিপুরার মধ্যে; পাহাড়ি অঞ্চলে। বার্মিজ ফল্ট বলা হয় একে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এই এলাকায় ১০০ বছর পরপর একটি বড় মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়ে আসছে।
ইতিহাস বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার এ অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে ১৫৪৮ সালে। তার উৎপত্তিস্থল ছিল চট্টগ্রামে। এর প্রায় ১০০ বছর পর ১৬৪২ সালে একটি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয় সিলেট অঞ্চলে। এরও ১০০ বছর পর ১৭৬২ সালে রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। সেই গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্পের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথই পাল্টে গিয়েছিল। সর্বশেষ ১৯১৮ সালে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল সিলেট অঞ্চলে।
যদিও এসব ভূমিকম্পের কারণে তখন এ অঞ্চলে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি; কারণ এখনকার মতো তখন নগরায়ণ ছিল না; ১০০ বছরের ধারাবাহিকতায় এখন যদি আবার সে রকম ভূমিকম্প হয়, তাহলে কী হবে?
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট– তিনটি শহরই মেট্রোপলিটন হিসেবে ঘোষিত। এই তিনটি শহরেই অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন তৈরি, নিচু জায়গা বা জলাশয় ভরাট করে ইমারত নির্মাণ এবং ৩০ শতাংশ ফাঁকা জায়গা না রাখার মতো ব্যত্যয় ব্যাপকভাবে ঘটেছে। তিনটি শহরে আড়াই লাখ ভবন রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ, যা বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যাবে। সিডিএমপির (২০০৯) এক গবেষণায় দেখা যায়, রাজধানীর ২৪ শতাংশ (যা সংখ্যায় ৭৮ হাজার) ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। চট্টগ্রামের আর্থকোয়াক ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ সেন্টার ও সিডিএমপির গবেষণা বলছে, চট্টগ্রাম মহানগরীর ১ লাখ ৮৪ হাজার ভবনের মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। সিলেটের অবস্থাও প্রায় একই।
ওই গবেষণা বলছে, ভবনধস এবং ফ্লাইওভার ধসের ফলে প্রায় ৭ কোটি টন কংক্রিটের স্তূপ হবে শুধু রাজধানীতে। এই বিপুল পরিমাণ কংক্রিটের স্তূপ খুবই দ্রুততার সঙ্গে অপসারিত না হলে কোনো ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থাই কাজ করবে না। আটকে পড়া মানুষ উদ্ধার, মেডিকেল ট্রিটমেন্ট, আশ্রয়হীন মানুষের জন্য থাকা-খাওয়া ইত্যাদির ব্যবস্থা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
রাজধানী ঢাকায় ভূমিকম্প হলে দ্বিতীয় যে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে, তা হলো বিদ্যুৎ বিপর্যয়। খুব দ্রুততার সঙ্গে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা চালু করতে না পারলে রাজধানীর মানুষের খাওয়ার পানির জন্য হাহাকার লেগে যাবে। তৃতীয়ত গ্যাস বিস্ফোরণ তৈরি করবে বড় মাত্রার যে কোনো ধস। এর সঙ্গে আরেকটি বিপর্যয় তৈরি হবে, তা হলো আগুন। অধিকাংশ জায়গায় বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটবে। প্রতিটি ব্যাংকের কার্যক্রম অনলাইনে হওয়ায় বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ফলে সারাদেশ তথা বৈশ্বিক বাণিজ্যেও এর ভয়াবহ প্রভাব পড়বে। নগদ টাকার জন্য মানুষ হাহাকার করবে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রধান মাধ্যম হলো মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও ওয়্যারলেস। ঢাকা শহরে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে এই তিন যোগাযোগ ব্যবস্থাই সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বে। মানুষ তার পরিবার-পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে না। সরকারের সব মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর বা অন্যান্য বাহিনী আন্তঃযোগাযোগও করতে পারবে না। পূর্ব প্রস্তুতি না থাকলে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ।
২০১৫ সালে নেপালে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের পর বাংলাদেশের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের বৈঠকে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এ ছাড়া ওই বৈঠকে ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম তৈরির সিদ্ধান্তও হয়েছিল। কিছু কাজ হয়েছে, কিন্তু পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, সারাদেশে তাদের সব মিলিয়ে ১৪ হাজার লোকবল রয়েছে। এর তিন ভাগের এক ভাগ রাজধানীতে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ নন-অপারেশনাল কাজে নিয়োজিত। অথচ রাজধানী ঢাকাতে প্রায় ৪০ হাজার পুলিশ সদস্য কর্মরত। তাঁদের যদি দুর্যোগের সময় সার্চ বা ফার্স্ট এইডসহ প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুত রাখা যায়, তাহলে ফায়ার সার্ভিসের সীমিত জনবলের সঙ্গে পুলিশ সদস্যরা দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজ করতে পারবেন।
দুর্যোগের পর উদ্ধারকাজের পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কী প্রয়োজন; উদ্ধার কাজে সমন্বয়ের বিশদ পরিকল্পনা, যা স্ট্যান্ডিং অর্ডার অন ডিজাস্টারে (এসওডি) উল্লিখিত। এসওডি গুরুত্বসহ প্রতিপালনের সর্বোত্তম সময় এখনই। তা না হলে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সেই দুঃস্বপ্নের দিন আর দুর্ভাবনার রাতের কথা মানসপটে ভেসে এলেই গা শিউরে ওঠে।
আজহার মুকুল: অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার, ডিএমপি
মন্তব্য করুন