ইটপাথরের দেয়াল দিয়ে তৈরি বিশাল প্রাচীরঘেরা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম এই ক্যাম্পাসে উৎসব আয়োজন লেগেই থাকে।

এই তো কিছুদিন আগেই যান্ত্রিক এই শহরজুড়ে ফাল্গুন এলো। বসন্তের সেই রঙিন আলিঙ্গন এখানেও এসেছিল। এর মাঝে একদিন হঠাৎ করেই প্লাজা চত্বরে দেখা গেলো ছোট্ট একটি চায়ের টং দোকান ! দোকানের ওপরে স্পষ্টভাবে লেখা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক ক্লাব। টি ফর টক। কয়েক সারি চিপস, কয়েকটি বক্সে সাজানো বিস্কুট , একপাশে চা বানানোর প্রয়োজনীয় সবকিছু সাজানো । পাশেই একটি সাদা বোর্ড । সেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা অনেকগুলো সাম্প্রতিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও সামাজিক বিষয়। মোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে, যে কোনো একটি বিষয় নির্ধারণ করুন এবং টং-এ ফিরে আসুন। বসুন এবং চায়ের সঙ্গে আলোচনা করুন আমাদের সঙ্গে। 

আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে শুরু করে আলোচিত মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব। মহাবিশ্বের গ্রহ-উপগ্রহ থেকে শুরু করে প্লুটো। শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া হওয়া থেকে শুরু করে পাকিস্তানের নেতৃত্ব সংকট। গ্রামের ছোট্ট খুচরা দরের বাজার থেকে বিশ্ববাজার । টেকনাফ থেকে তেতুঁলিয়া। এমনকি পৃথিবীর উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু। সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি থেকে শুরু করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে প্রায় এমন কোনো কিছুই নেই– যে বিষয়টি নিয়ে চায়ের দোকানে আলোচনার ঝড় ওঠে না। এমনকি নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র কিম্বা বিগব্যাং তত্ত্ব কার আবিষ্কার, এসব নিয়েও সকাল সন্ধ্যায় চায়ের দোকানগুলোতে চলে তর্কবিতর্ক । সন্ধ্যার সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তুগুলো ভারি হয়ে উঠতে শুরু করে। জাতীয় সংসদ ভবনের মতোই কখনও গুরুগম্ভীর আলোচনা, কখনও আবার হাস্যরসাত্মক কথা; কোনো কিছুই বাদ যায় না চায়ের দোকানের আলোচনা সভায়। দোকানগুলোতে শুধু একদল কিম্বা দুই দল নয়, হয় বহুদলীয় সভা। চায়ের কাপের টুং টাং শব্দের সঙ্গে কমপক্ষে অর্ধশতাধিক ভিন্ন চিন্তার লোকের সমাগম হয় রোজ। কেনো আপনি মনে করেন , চীন-রাশিয়া বলয় ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের একটি হুমকি? এরই মধ্যে আরেক দলের আলোচনার বিষয়বস্তু ঠিক হয়ে গেছে। তারা বলছে, আপনার ধারণা অনুযায়ী রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ কী? ইতিহাস বলছে স্বার্থ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না। আরেক দলের আলোচনা বেশ আকর্ষণীয়। তারা বলছে, ধনীদের জন্য অতিরিক্ত ট্যাক্স নির্ধারণ করা উচিত কিনা ! গঠনমূলক সমালোচনার এপিঠওপিঠ। চায়ের কাপে ততক্ষণে আড্ডা জমে উঠেছে।

এমন একটি আকর্ষণীয় আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক ক্লাব। বছরের শুরুতেই নবীন শিক্ষার্থীদের যুক্তিনির্ভর পৃথিবীর প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য নিয়মিত এমন কার্যক্রম পরিচালনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক ক্লাব। মূলত নতুনদের বরণ করে নিতেই এমন আয়োজন চলে । ঠিক ৩০ বছর আগে এমন একটি ঘুণে ধরা বাঁশ আর বাঁশপাতার নড়বড়ে ছাউনি দিয়ে বানানো টং ঘরে বসেই শুরু হয়েছিল এনএসইউডিসির গল্প। আবার কখনও কখনও ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে সাহিত্য আড্ডাও হয় এখানে। শার্লক হোমস আসেন, ফেলুদা আসেন। হিমু-রূপারা উদাস হয়ে ঘুরে বেড়ায়। মিসির আলি আড়চোখে তাকিয়ে দেখেন আর হাসেন। মাঝে মাঝেই দেখা যায়, আনমনে একটি ছেলে দূরে দাঁড়িয়ে কবিতা লিখছে, হাতে শীতল হয়ে যাওয়া লাল চা। কবিতার চেয়েও ভয়াবহ সুন্দর অবনীতাদের গল্পে গন্ধে– জমে ওঠে নিভু নিভু আলো ছড়ানো অনেক দিনের পুরোনো টং দোকান।