খুলনা নগরীসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি আলোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটলেও মূল হোতারা ধরা পড়েনি। তাদের ব্যবহৃত অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি। সন্ত্রাসী, চরমপন্থি ও ভাড়াটে খুনিদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।

পুলিশের গোয়েন্দা শাখা সূত্রে জানা গেছে, নগরীর শীর্ষ সন্ত্রাসী রনি চৌধুরী বাবু ওরফে গ্রেনেড বাবুর সন্ধান পাচ্ছে না তারা। মাদক ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন কচি হত্যা মামলায় গত ২৭ মার্চ আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। গ্রেনেড বাবুর ঘনিষ্ঠ সুমন শেখ ওরফে বোমা সুমন, কালা রনি ওরফে হাসিবুর রহমান, সোহেল, রিয়াজ মীর, সোহাগ নগরীতেই রয়েছে। গ্রেনেড বাবু নগরীর আহসান আহমেদ রোড ও বোমা সুমন বাইতিপাড়া এলাকার বাসিন্দা। এ ছাড়া টুটপাড়া, লবণচরা, চানমারি ও জিন্নাহপাড়া এলাকায় সক্রিয় রয়েছে নূর আজিম ও আশিকের নেতৃত্বে দুটি সন্ত্রাসী গ্রুপ।

গত ২৪ মার্চ নগরীর শিরোমনি পূর্বপাড়া এলাকায় জুমার নামাজ পড়ে বাসায় ফেরার পথে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আনসার উদ্দিন নিহত হন। তিনি দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর ইউনিয়নে গত নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হয়েছিলেন। তাঁর ছেলে তানভীর শেখ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পাভেল গাজীসহ ২৩ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতপরিচয় সাত-আটজনকে আসামি করে ২৬ মার্চ খানজাহান আলী থানায় মামলা করেন। তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর বাবা আবারও ইউপি চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন। সে কারণে বর্তমান চেয়ারম্যান ও তাঁর লোকজন ভাড়া করা সন্ত্রাসীদের দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। খানজাহান আলী থানার ওসি মো. কামাল হোসেন বলেন, এ মামলায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। 

গত ৩ মার্চ খানজাহান আলী থানার গিলাতলা ২ নম্বর কলোনি এলাকায় বোমা বিস্ফোরণে চরমপন্থি নেতা জহিরুল ইসলাম লাল্টু, তার সহযোগী শহীদুল ইসলাম টেনা ও সাগর আহত হন। ওসি কামাল হোসেন খান জানান, তাঁরা কারও ওপর বোমা হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। একটি দোকানে চা খাওয়ার সময় তাদের কাছে থাকা বোমা বিস্ফোরিত হয়। তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গত ৩০ জানুয়ারি সকালে ফুলতলা উপজেলার আলকা গ্রামে সড়কের পাশে প্রকাশ্যে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ব্যবসায়ী মিলন ফকির নিহত হন। ফুলতলার শিকিরহাট খেয়াঘাটের ইজারা নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে তাঁর পরিবারের অভিযোগ। এ ঘটনায় শীতল কান্তি মণ্ডল নামে একজন স্কুলশিক্ষক গুলিবিদ্ধ হন। ক্লোজসার্কিট ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, দুই সন্ত্রাসী মোটরসাইকেলে এসে তাঁকে গুলি করে পালিয়ে যায়। মিলনের স্ত্রী রাশিদা বেগম বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় সন্ত্রাসীদের আসামি করে মামলা করেন। হত্যাকারীরা এখনও ধরা পড়েনি, উদ্ধার হয়নি অস্ত্র।

গত ২৯ জুন রাতে নগরীর মুজগুন্নি বাসস্ট্যান্ডে প্রধান সড়কের ওপর সন্ত্রাসীদের গুলিতে দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটি বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোল্লা জুলকার নাইম মুন্না নিহত হন। তিনি তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। মুন্না দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটী ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক গাজী আবদুল হালিম হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি এবং দৌলতপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী হুজি শহীদ হত্যা মামলার আসামি। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি মামলা রয়েছে। এ ঘটনায় নিহতের বোন হুমায়রা বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে খালিশপুর থানায় মামলা করেন। কিন্তু হত্যায় জড়িতরা ধরা পড়েনি।

গত বছর ৬ অক্টোবর দুপুরে নগরীর চাঁনমারি খ্রিষ্টানপাড়া এলাকায় সন্ত্রাসীরা পলাশ নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা ও সৌরভ নামে আরেক যুবককে কুপিয়ে আহত করে। টুটপাড়া এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী নূর আজিমের গ্রুপের সঙ্গে পলাশের দীর্ঘদিনের বিরোধ ছিল। গ্রুপের ৮-১০ জন এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। সন্ত্রাসী নূর আজিম এখনও ধরা পড়েনি। তবে ২৮ অক্টোবর পশ্চিম টুটপাড়া এলাকা থেকে পুলিশ দুটি পিস্তল ও একটি গুলির খোসাসহ নূর আজিমের সহযোগী নাহিদ হাসান সরদারকে আটক করে। চাঁনমারী এলাকার আরেক সন্ত্রাসী আশিক এখনও ধরা পড়েনি। খুলনা সদর থানার ওসি মো. হাসান আল মামুন জানান, নূর আজিম ও আশিককে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর নগরীর ৩ নম্বর কাশেম সড়কে ইয়াসিন নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার অভিযোগে ১৮ সেপ্টেম্বর কিশোর গ্যাংয়ের দুই সদস্য অনি ও মাসুদ রানাকে আটক করে পুলিশ। কিন্তু তাদের সহযোগীরা এখনও ধরা পড়েনি।

গত বছর ১২ জুন দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি গাজী জাকির হোসেনকে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে আহত করে। ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২ আগস্ট তিনি মারা যান। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আনসার উদ্দিনের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জের ধরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। এই হত্যার সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ আসামি এখনও ধরা পড়েনি।

গত বছর ১৬ জানুয়ারি নগরীর বয়রা কলেজ সড়কে যুবলীগ নেতা শেখ সাইদুর রহমান শাওন ওরফে ট্যাংকি শাওনকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ও বোমা হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। হামলার পর পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ দুটি বিদেশি অস্ত্র, ১১ রাউন্ড গুলি ও একটি বোমাসহ সাইদুল নামে একজনকে আটক করে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এই হামলায় অংশ নেয় শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেনেড বাবুসহ ছয়জন।

সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মো. বাবুল হাওলাদার। তিনি সমকালকে বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরাও এলাকায় ফেরার চেষ্টা করতে পারে। এই নির্বাচনে প্রার্থীদের পক্ষে-বিপক্ষে সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হতে পারে। সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন।

মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন বলেন, পুলিশ সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের চেয়ে বিএনপির নেতাকর্মী দমনে বেশি সক্রিয়। অধিকাংশ সন্ত্রাসী ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম ডি এ বাবুল রানা সমকালকে বলেন, ক্ষমতাসীন দলের কেউ সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন না। সন্ত্রাসী-অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের আরও তৎপর হওয়া উচিত। 

এ ব্যাপারে র‍্যাব-৬-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মোস্তাক আহমেদ বলেন, নগরীতে কিশোর গ্যাংয়ের কিছু সদস্য এবং কিছু সন্ত্রাসী তৎপর রয়েছে। এদের গ্রেপ্তারের জন্য তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মাসুদুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, সন্ত্রাসী ও খুনিদের গ্রেপ্তারে তাঁরা সবসময়ই চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

বিষয় : খুলনায় দৌরাত্ম্য সন্ত্রাসী ও চরমপন্থিদের

মন্তব্য করুন